আইরিশ বাংলাপোষ্ট ডেস্কঃ নবীর ব্যাংগচিত্র প্রকাশ এবং ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রোনের বিতর্কিত বক্তব্যের প্রতিবাদে পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশ, ফিলিস্তিণ থেকে লেবানন, আফগানিস্তান থেকে মিশর সহ বিশ্বের মুসলিম অধ্যুষিত দেশগুলোতে হাজার হাজার মানুষ গতকাল রাজপথে বিক্ষোভ করেন।
বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকায় জুমার নামাজের পর আনুমানিক ৫০ হাজার মানুষ মিছিল করেছে। বিক্ষোভকারীরা “বিশ্ব মুসলিম ঐক্যবদ্ধ হও”, “ম্যাক্রনকে উচ্চ মূল্য দিতে হবে,” “ইসলামোফোবিয়া বন্ধ করুন” এবং “ম্যাক্রন হলো শয়তান” লেখা ব্যানার বহন করছিল।প্রতিবাদকারীরা তাদের বক্তব্যে “বাংলাদেশ সরকারকে ফ্রান্সের পণ্য বর্জন ও সরকারীভাবে প্রতিবাদ জানানোর আহবান জানান।”
পাকিস্তানের বৃহত্তম শহর করাচিতে প্রায় ১০ হাজারের বেশী মানুষ মিছিল করেছে। রাজধানী ইসলামাবাদে বিক্ষুব্ধ জনতা ফরাসী দূতাবাসের দিকে যাওয়ার চেষ্টা করলে পুলিশ টিয়ার গ্যাস নিক্ষেপ করে এবং লাঠিপেটা করে তাদের পিছু হটিয়ে দেয়। ইমানুয়েল ম্যাক্রোনের কুশপুত্তলিকাকে রাস্তায় ঝুলিয়ে জুতাপেটা করা হয়। লাহোরে নবীর জন্মদিনের অনুষ্ঠান শেষে হাজার হাজার অনুসারীরা ব্যানার নিয়ে ফ্রান্স বিরোধী শ্লোগান দিয়ে বিক্ষোভ প্রকাশ করেন। পাঞ্জাবের মুলতানেও বিক্ষুব্ধ জনতা ম্যাক্রোনের কুশপুত্তলিকা দাহ করে এবং সরকারকে ফ্রান্সের পণ্য বর্জনের আহবান জানায়।
এদিকে লেবাননের রাজধানী বৈরুতেও বিক্ষোভ অনুষ্ঠিত হয়। শতাধিক বিক্ষোভকারী লেবাননে ফরাসী রাষ্ট্রদূতের সরকারী বাসভবনের দিকে ধাবিত হলে পুলিশ তাদের আটকে দেয়। আন্দোলনকারীরা কালো ও সাদা পতাকা উত্তোলন করে বিভিন্ন স্লোগানে প্রতিবাদ জানায়।
জেরুজালেমে কয়েক শত ফিলিস্তিনি আল-আকসা মসজিদের বাইরে বিক্ষোভ করেন, স্লোগানে তারা বলেন “আমাদের নবীর জন্যে প্রাণ ও রক্ত দিতে প্রস্তুত।” পুরনো শহরের এসপ্ল্যানেডের বাহিরে পুলিশ বিক্ষোভকারিদের সমাবেশকে ছত্রভংগ করে দেয় এবং কয়েকজনকে আটক করেছে বলে সূত্রে প্রকাশ। এদিকে গাজা উপত্যকায় আরও জনগণ ফ্রান্স বিরোধী বিক্ষোভ ও সমাবেশ করেছে।
আফগানিস্তানে হিজব-ই-ইসলামীর সদস্যরা ফরাসি পতাকা জ্বালিয়ে দেয়। সমাবেশে তাদের নেতা গুলবুদ্দিন হেকমতিয়ার ম্যাক্রনকে হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেন “পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ না করলে, তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ অনুষ্ঠিত হতে পারে আর এর জন্য ইউরোপ দায়বদ্ধ থাকবে”।
আফগানিস্তানের রাজধানী কাবুল এবং আরও কয়েকটি প্রদেশে হাজার হাজার মানুষ রাস্তায় “ডেথ টু ফ্রান্স” শ্লোগান দিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করে। বিক্ষোভকারীরা ম্যাক্রোনের প্রতিকৃতিকে পদদলিত করে এবং ফরাসি দূতাবাস বন্ধের দাবী জানায়। দেশটির পশ্চিমাঞ্চলীয় হেরাত প্রদেশে, বিক্ষোভকারীরা একটি ক্রেনের উপরে ম্যাক্রোনের একটি প্রতিকৃতি জ্বালিয়ে দেয়।
মিশরের রাষ্ট্রীয় টিভিতে সরাসরি সম্প্রচারিত শুক্রবারের একটি খুতবায়, দেশটির ধর্ম মন্ত্রী ব্যাংগচিত্র প্রকাশের প্রতিবাদে কোনও ধরনের সহিংস প্রতিশোধ নেওয়ার নিন্দা করেছেন।
কেন এই প্রতিবাদ?
অক্টোবর মাসের ২ তারিখে ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রোন এক বক্তৃতায়, “বিশ্বব্যাপী ইসলাম সংকটে” এবং ফ্রান্সে ধর্মীয় নিয়ন্ত্রণের ব্যাপ্তি বাড়ানোর জন্যে ডিসেম্বর মাসে একটি নূতন আইন করার কথা প্রকাশ করেন।
এদিকে প্যারিসের শহরতলির ইতিহাসের শিক্ষক স্যামুয়েল পেটি ৩রা অক্টোবর তাঁর ক্লাসে নবী মুহাম্মদের ব্যাংগচিত্র প্রদর্শন করে মত প্রকাশের স্বাধীনতার শিক্ষা প্রদান করলে, ১৮ বছর বয়সী আব্দুল্লাহ আজরফ গত ১৬ই অক্টোবর রাজপথে স্যামুয়েল পেটিকে নৃশংস ভাবে হত্যা করেন। ফ্রান্সের পুলিশ আব্দুল্লাহ আজরফকে সাথে সাথে গুলি করে হত্যা করে।
এই মর্মান্তিক ঘটনার পর ইমানুয়েল ম্যাক্রোন পুনরায় “ইসলামিস্ট টেরোরিজম” এর কথা বলে এর বিরুদ্ধে যুদ্ধের কথা বলেন। তুরস্কের প্রেসিডেন্ট এরদোগান ইমানুয়েল ম্যাক্রোনকে “মানসিক রোগী” আখ্যায়িত করে বলেন, “উনার কি হয়েছে যে উনি ইসলামের বিরোধিতা করছেন।” ফ্রান্স এরদোগানের বক্তব্যের প্রতিবাদে তাদের রাষ্ট্রদূতকে তুরস্ক থেকে ফিরে আসার আদেশ দেয়। এদিকে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানও এর সমালোচনা করেন এবং তুরস্ক রাষ্ট্রদূতকে তলব করে সরকারী ভাবে প্রতিবাদ জানানো হয়।
এদিকে গত ২৯শে অক্টোবর বৃহস্পতিবার ফ্রান্সের নিসে তিউনিসিয়া থেকে সম্প্রতি আসা এক ব্যাক্তি গীর্জায় প্রবেশ করে তিনজনকে ছুরিকাঘাতে নৃশংসভাবে হত্যা করে। এরপর পুলিশ গুলি করে এই সন্ত্রাসিকে আহত অবস্থায় গ্রেফতার করেছে বলে সংবাদে প্রকাশ।
বিশ্বব্যাপী এই নৃশংস হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে নিন্দা ও শোক প্রকাশ অব্যাহত আছে। সমগ্র ফরাসি জাতি শোকে মুহ্যমান। ইমানুয়েল ম্যাক্রোন পুনরায় “ইসলামিক টেরোরিজম” এর বিরুদ্ধে সারা জাতিকে ঐক্যবদ্ধ থাকার আহবান জানিয়েছেন। পুলিশ ও অন্যান্য সামরিক আধা সামরিক বাহিনীকে প্রস্তুত রাখা হয়েছে।
ফ্রান্সে দীর্ঘদিন থেকে ধর্মের নামে নৃশংসতা চলছে। কেন চলছে সেটার একটা দীর্ঘ পটভূমি আছে। নৃশংস হত্যাকাণ্ড যে মানবিক নয় এবং কোন ধর্মই নৃশংসতা সমর্থন করেনা এই সম্পর্কে কেউ দ্বিমত পোষণ করছেন কিংবা করেছেন বলে কোথাও শোনা যায় নি। সেমুয়েল পেটি হত্যকান্ড এবং গত বৃহস্পতিবারের হত্যাকাণ্ড যে ঘৃণিত এবং নিন্দিত সে সম্পর্কে কারো কোন মত বিরোধ নেই। সারা বিশ্বই এই হত্যাকাণ্ডের নিন্দা করেছে এবং বিচার কামনা করেছে।
এই নৃশংসতা চিরদিনের জন্য অবসান হোক সেটা সবাই কামনা করেন। কোথাও নৃশংসতা দিয়ে নৃশংসতার অবসান হয়েছে বলে শোনা যায়নি। নৃশংসতা বন্ধ করার জন্য চাই রাজনৈতিক দূরদর্শিতা আর নেতৃত্বের দক্ষতা। ফ্রান্সের ধর্ম নিরপেক্ষতা যদি অন্য ধর্মাবলম্বীর ধর্ম বিশ্বাসে আঘাত করার নাম হয়ে থাকে তাহলে সেটা যে নিরপেক্ষতা নয় তা যত দ্রুত বোধগম্য হয় ততই মঙ্গল। ফরাসী দেশে ৫০ লক্ষ মুসলিমের বসবাস, এই ধর্মাবলম্বীরা তাদের নবীর ছবিও ছাপতে পছন্দ করেনা, সেখানে নিজ দেশ যদি ব্যাংগচিত্র ছাপানোকে সমর্থন করে তাহলে তাদের জন্য সেটা খুব সুখকর সংবাদ নয়। আর অন্যের মনোজগতে আঘাত করতে পারে এরকম বক্তব্য কিংবা রচনা মত প্রকাশের স্বাধীনতা বলে চালিয়ে দেওয়াও যে সুখকর নয় সেটাও অনুধাবন করা শান্তি ও প্রগতির জন্য ইতিবাচক হবে।
আরেকটি কথা না বললেই নয় যে, নবীর ব্যাঙ্গচিত্র প্রকাশিত হওয়াটা কাম্য নয় কিন্তু যদি কেউ সেই অশোভন কাজটি করে ফেলে তাহলে সেটার প্রতিকার এবং প্রতিবাদের অনেক ভাষা আছে কিন্তু নবী মুহাম্মদ কোথাও কখনো নৃশংসতা দিয়ে কোন কটূক্তি কিংবা অশোভনের বিনিময় চেয়েছেন, করেছেন কিংবা করতে বলেছেন সেটাও কেউ দেখাতে পারবেন বলে মনে হয়না। ইসলাম ধর্মে বরং বারে বারে ধৈর্য্যের কথা বলে হয়েছে, ভাল ব্যাবহারের কথা বলা হয়েছে। কোরানে এমনও বলা হয়েছে যে, একটি হত্যা সারা মানবতা হত্যার সমকক্ষ। তাই কোন মুসলিমের আচরণ যেমন এটা হতে পারেনা একই সাথে ধর্ম নিরপেক্ষতা এবং মত প্রকাশের স্বাধীনতাকেও ভিন্ন ভাবে দেখা এখন সময়ের দাবী।