আইরিশ বাংলাপোষ্ট ডেস্কঃ করোনা ভাইরাস বা কোভিড-১৯ বর্তমান পৃথিবীতে একটি আতঙ্কের নাম। প্রতিদিন হাজার হাজার মানুষ কোভিড-১৯ এ আক্রান্ত হয়ে মত্যুবরণ করছেন। আক্রান্তের সংখ্যাও বৃদ্ধি পাচ্ছে দিন দিন। এ সময় ব্যক্তিগত সচেতনতা গড়ে তোলার পাশাপাশি শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাও বাড়াতে হবে। এমনটাই বলছেন- বিশেষজ্ঞরা।
চিকিৎসকদের পরামর্শ অনুযায়ী অনেকেই হয়তো সুষম খাবার গ্রহণ ও শরীর চর্চার মাধ্যমে নিজেদের ইমিউন সিস্টেমকে শক্তিশালী করার চেষ্টা করছেন। তবে সব খাবারই কিন্তু পুষ্টিকর নয়, কিছু কিছু খাবার আছে যেগুলো শরীরে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমায়। তাই আগে জানতে হবে কী খাবেন, আর কী বর্জন করবেন। মোট কথা খাওয়া দাওয়ায় আনতে হবে শুদ্ধাচার।
ভিটামিন সমৃদ্ধ খাবার খান
শরীরে ভিটামিন এ, সি, ডি, ই এবং বি ২-এর মতো জরুরি ভিটামিনস থাকলে সমস্ত রোগের সঙ্গে মোকাবিলা করতে আপনি তৈরি। ভিটামিন ওষুধ বা সাপ্লিমেন্ট খেয়ে নয়, ডায়েটে রাখুন গাজর, ব্রক্কলি, সাইট্রাস ফল, অ্যাভোকাডো, বাদাম এবং মরশুমী সবজি। বেশি করে এগুলোই এখন ঘুরিয়ে ফিরিয়ে খান।
খান কম, পান করুন বেশি
শরীরের প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ানোর জন্য প্রচুর পানীয় রয়েছে। যেমন, হলুদ দুধ, বা দারুচিনি, আদা এবং আরও মশলা মিশিয়ে তৈরি হলুদ লেট্টি। লেবু, আদা এবং মধু দিয়ে তৈরি পানীয়। আর খেতে পারেন টক দইয়ের ঘোল, কমলা-হলুদ-পাতিলেবুর সরবত।
জিঙ্কযুক্ত খাদ্য গ্রহণ
মাংস : গরু ও মুরগির মাংস দুটোতেই জিঙ্ক রয়েছে। তবে চর্বির পরিমাণ বেশি থাকায় হৃদরোগ, কোলেস্টেরল, প্রেশার, সুগার বা ওবেসিটির সমস্যায় যারা আছেন, তারা গরুর মাংসের বদলে মুরগির মাংস খেতে পারেন। তবে গ্রাম বা উন্মুক্ত অঞ্চলের গরু যেটাকে আমরা অর্গানিক গরু বলে থাকি, সেই গরুর ১০০ গ্রাম মাংসে ৪.৮ মিলিগ্রাম জিঙ্ক থাকে। এছাড়াও গরুর মাংসে প্রোটিন, আয়রন, বি ভিটামিনসহ গুরুত্বপূর্ণ পুষ্টির এক দুর্দান্ত উৎস।
মাশরুম : লো-ক্যালরির সবজি মাশরুমেও আছে পর্যাপ্ত জিঙ্ক। আছে ভিটামিন এ, সি, ই ও প্রচুর আয়রন। তাই করোনাকালীন সময়ে স্বাস্থ্য সুরক্ষার জন্য মাঝে-মধ্যে মাশরুম খেতে পারেন।
ওটস : ওটসে রয়েছে প্রচুর ক্যালসিয়াম, ম্যাগনেসিয়াম, জিঙ্ক, কপার, ম্যাঙ্গানিজ, থিয়ামিন, ভিটামিন ইত্যাদি যা অন্যান্য শস্যজাতীয় খাবারের তুলনায় বেশি। প্রাকৃতিকভাবে ফ্যাটের পরিমাণ কম থাকে ওটসে। তাছাড়া উপকারি ফ্যাটি অ্যাসিড, মানে মনোস্যাচুরেটেড ফ্যাটও রয়েছে। ওটসের বেটা-গ্লুকোন শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বা ইমিউনিটি সিস্টেমকে বৃদ্ধি করে। শরীরে ব্যাক্টেরিয়া জনিত ইনফেকশন প্রতিরোধেও সাহায্য করে ওটস।
দুগ্ধজাত খাবার : পনির বা দুধের মতো দুগ্ধজাত খাবারে প্রচুর পুষ্টি উপাদান এবং জিংক রয়েছে। দেহ এই জিঙ্ক সহজে শোষণ করতে পারে। এই খাদ্যগুলো প্রোটিন, ক্যালসিয়াম, ভিটামিন ডি-সহ হাড়ের স্বাস্থ্যের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। ২৫০ গ্রাম লো-ফ্যাট ইয়োগার্ট এবং ২ দশমিক ৩৮ মিলিগ্রাম লো-ফ্যাট দুধ খেলে ১ দশমিক ০২ মিলিগ্রাম জিঙ্ক শরীরে ঢুকবে।
নানা ধরনের ডাল : ৫০ গ্রাম মসুরের ডালে ২ দশমিক ৪ মিলিগ্রাম, ৯০ গ্রাম রাজমায় ২ দশমিক ৫ মিলিগ্রাম, ৮০ গ্রাম ছোলায় ১ দশমিক ২৫ মিলিগ্রাম জিঙ্ক আছে। মুগ ডাল ও ছোলাও উপকারী। এগুলো নিয়মিত খেতে পারেন।
সবজি : এমনিতেই শরীরের জন্য বেশ উপকারী সবুজ শাকসবজি। এর মধ্যে পালংশাক, ব্রোকলি ও রসুনে প্রচুর জিঙ্কের রয়েছে। তাই এগুলো খাদ্যতালিকায় রাখতে পারেন।
বাদাম ও কুমড়ার বীজ : ২৮ গ্রাম কাজুবাদাম আর কুমড়া বীজে যথাক্রমে ১ দশমিক ৬ মিলিগ্রাম ও ২ দশমিক ২ মিলিগ্রাম জিঙ্ক আছে। আমন্ড, অন্যান্য বাদাম ও বীজে প্রচুর জিঙ্ক থাকে। তাই এগুলো রাখতে পারেন খাদ্য তালিকায়।
ডার্ক চকোলেট : এতে পর্যান্ত পরিমাণ জিঙ্ক পাওয়া যায়। ১০০ গ্রাম ওজনের একটি চকোলেট বারে ৩.৩ মিলিগ্রাম জিঙ্ক থাকে। তাই খাদ্য তালিকায় রাখুন ডার্ক চকোলেট।
ভিটামিন সি
শরীরে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে হলে লেবু খাওয়ার পরিমাণ বাড়াতে হবে। এর সর্বোত্তম পন্থা হলো পানিতে লেবু চিপে সরবত করে খাওয়া। তবে এই সরবতে চিনি না নিলেই বেশি উপকার।
লেবুতে রয়েছে প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন সি। তাই লেবুপানি তৈরিতে ছোট হলে একটা লেবুর রস ৮ আউন্স উষ্ণ বা স্বাভাবিক পানিতে মেশান। স্বাস্থ্যকর পানীয় তৈরির জন্য ফিল্টারের পানি এবং টাটকা লেবু ব্যবহার করা জরুরি।
আনারস
এই করোনা ভাইরাস মহামারীর সময়ে আপনার রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে খেতে পারেন আনারস। ফ্ল্যাভোনয়েড থাকায় আনারস পুষ্টিগুণেও ভরপুর।
পুষ্টি বিজ্ঞানীদের মতে, সহজলভ্য এই আনারসে রয়েছে প্রচুর পরিমাণে রোগ প্রতিরোধী অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট, যা শরীরকে ফিট ও সুস্থ রাখতে সাহায্য করে। এছাড়াও ফাইবার, ভিটামিন-সি, পটাশিয়াম, ফোলেট, ম্যাগনেসিয়াম, ম্যাঙ্গানিজ, ইত্যাদিতে ভরপুর এই ফল। আনারস কেবল পুষ্টিতে সমৃদ্ধ নয়, এতে রয়েছে স্বাস্থ্যকর অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট, যা অক্সিডেটিভ স্ট্রেস কমাতে সহায়তা করে।
আমলকি
প্রতিদিন সকালে কাঁচা আমলকি চিবিয়ে বা এর রস বাড়িতে তৈরি করেও খেতে পারেন, এতে অনেক উপকার পাবেন। শরীরে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি পাবে। আমলকির রস রক্ত পরিষ্কার করতে সাহায্য করে। প্রতিদিন আমলকি রস সেবনে জটিল রোগ থেকে মুক্ত হওয়া সম্ভব হবে। আমলকির রস পান করলে দৈনিক প্রয়োজনীয় ৪৬ শতাংশ ভিটামিন সি-এর প্রয়োজন মিটবে, পাশাপাশি এতে তামাও রয়েছে। এই দুটি রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াবে। করোনার এই সময়ে আমলকি অত্যান্ত কার্যকর একটি প্রতিষেধক।
ফুসফুস ভালো রাখতে
করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হলে ফুসফুসে সংক্রমণ হতে পারে। আর এই ফুসফুসে সংক্রমণ হলে দেখা দেয় শ্বাসকষ্ট। যার ফলে মৃত্যুও হতে পারে। তাই ফুসফুসকে সুস্থ রাখা অত্যান্ত জরুরি।
এই ফুসফুস সুস্থ রাখার বিষয়ে খাবারের রয়েছে বিশেষ ভূমিকা। পুষ্টিবিদদের মতে, শাক-সবজি, আলু, পটল, কুমড়া-গাজর বেশি করে খান। খোসা না ছাড়িয়ে তরকারি করে খেতে পারলে আরও ভাল।
আটার রুটি, ব্রাউন রাইস, কিনোয়া, বার্লি ইত্যাদি খান। এতে ফুসফুসের ক্ষতি যেমন কম হবে, ওজন ও ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে থাকবে। সেই সঙ্গে পটাশিয়ামসমৃদ্ধ খাবার ফুসফুসের জন্য ভালো। তাই সবুজ শাক, টমেটো, বিট, আলু, কলা খান নিয়মিত। আর প্রোটিনের জন্য মাছ, মাংস, ডিম, দুধ, দই, ডাল, ছোলা ইত্যাদি খেতে পারেন।
ফুসফুসের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা ঠিক রাখতে দিনে ২ থেকে ৩ লিটার পানি অবশ্যই পান করতে হবে। বিজ্ঞানীরা জানিয়েছেন, কয়েকটি বিশেষ খাবার রয়েছে যা ফুসফুসের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়।
পেঁয়াজ ও রসুন
পেঁয়াজ ও রসুন প্রদাহের প্রবণতা কমায় ও সংক্রমণের বিরুদ্ধে লড়াই করার শক্তি জোগায়। ‘জার্নাল অব ক্যানসার এপিডেমিওলজি’ ও ‘বায়োমার্কারস অ্যান্ড প্রিভেনশন’-এ প্রকাশিত প্রবন্ধে বিজ্ঞানীরা জানিয়েছেন, যেসব ধূমপায়ী কাঁচা রসুন খান তাদের ফুসফুসের বিভিন্ন অসুখে ভোগার আশঙ্কা প্রায় ৪০ শতাংশ কমে যায়।
আদা
আদা কুচি নিয়মিত খেলে ফুসফুস ভাল থাকে। হাতে পায়ের জয়েন্টে ব্যথা হলে সাহায্য নিতে পারেন আদার তেলের। খানিকটা অলিভ অয়েলে আদা ছেঁচে নিয়ে ফুটিয়ে নিন ৫ মিনিট। ঠাণ্ডা হলে ছেঁকে এই তেল দিয়ে ম্যাসাজ করুন হাতে পায়ের জয়েন্টে। আদার অ্যান্টিইনফ্লেমেটরি উপাদান দূর করে দেবে ব্যথা।
বমি বমি ভাব হচ্ছে? কিংবা মাথা ঘুরানো? একটুখানি আদা স্লাইস করে লবণ দিয়ে চিবিয়ে খেয়ে নিন। দেখবেন বমি ভাব একেবারেই কেটে গিয়েছে।
হজমে সমস্যার কারণে পেতে ব্যথা হলে আদা কুচি খেয়ে নিন। আদা পেতে গ্যাসের সমস্যা থেকেও মুক্তি দিতে বেশ কার্যকরী।
খাবারের পুষ্টি দেহে সঠিকভাবে শোষণ করার ক্ষমতা বাড়ায় আদা। তাই প্রতিদিন খুব সামান্য পরিমাণে হলেও আদা খাওয়া অভ্যাস করা উচিত সকলের।
কাঁচা মরিচ
কাঁচা মরিচ খেলে রক্ত সঞ্চালন ভাল হয়। সংক্রমণের আশঙ্কা কমে। কাঁচা মরিচের ভেতর রয়েছে বিশেষ এক উপাদান ক্যাপসাইকিন যা মরিচের ঝাল বাড়ায়। এই ক্যাপসাইকিনে আছে ভিটামিন এ, সি, বি-৬, আয়রন, পটাশিয়াম এবং খুবই সামান্য পরিমাণে প্রোটিন ও কার্বোহাইড্রেট। এই উপাদান গুলো মুখে লালা আনে ফলে খেতে মজা লাগে। এছাড়াও এগুলো ত্বক ও স্বাস্থ্যের জন্য খুবই উপকারী।
হলুদ
হলুদকে অনেকসময় ‘মিরাকল হার্ব’ বা অলৌকিক ভেষজ বলা হয়ে থাকে। হলুদ আমাদের কাছে অত্যন্ত পরিচিত একটা মশলা, রোজকার রান্নায় হলুদ না দিলে রান্নাটাই যেন কেমন অসম্পূর্ণ মনে হয়। হলুদের কারকিউমিন প্রদাহ কমায়। গবেষণায় দেখা গিয়েছে হলুদে প্রচুর মাত্রায় অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট ও অ্যান্টি ভাইরাল এবং অ্যান্টি-ব্যাকটেরিয়াল উপাদান সমূহ রয়েছে। তার সাথে হলুদের গুনাগুন মাত্রাকে আরো বাড়িয়ে দিয়েছে এর মধ্যে উপস্থিত অ্যান্টিফাঙ্গাল এবং অ্যান্টি-আর্সিনোজেনিক উপাদানসমূহ। এগুলি শরীরকে ভেতর থেকে রোগ মুক্ত করে স্বাস্থ্য রক্ষায় সহায়তা করে।
ফল ও সবজি
আপেল, পেয়ারা, শসা, সফেদা ইত্যাদি ফল ফুসফুসের জন্য খুবই ভাল। আপেল ও বাতাবি লেবুর ফ্ল্যাভেনয়েড ও ভিটামিন সি ফুসফুসের কার্যকারিতা বাড়ায়। এছাড়া গাজর, কুমড়ো, বেল পেপারে থাকে অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট ও ভিটামিন সি। সারা শরীরের পাশাপাশি ফুসফুসের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায় এসব সবজি।
সুত্রঃ একুশে টেলিভিশন