ডাঃ জিন্নুরাইন জায়গীরদারঃ বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনী এখন আমাদের খাবারের প্লেটে চলে এসেছে। কোনও প্রাণীকে আর জীবন দিতে হচ্ছেনা কিংবা কোন প্রাণীর জীবন নিতেও হচ্ছেনা, শুধুমাত্র দেহের পরিবর্তে ল্যাবে জন্মানো মাংস প্রথমবারের জন্য বিক্রয়ের জন্য অনুমোদন পেয়েছে। সিঙ্গাপুর ফুড এজেন্সি ডানা ঝাপটানো মুরগীর কোষ থেকে বেড়ে উঠা ইট জাস্টের “চিকেন বাইট” এর অনুমোদন দিয়েছে।
মার্কিন স্টার্টআপ “ইট জাস্ট” কোম্পানি একটি জীবন্ত মুরগির শরীর থেকে কোষের একটি বায়োপসি নিয়ে, এই কোষগুলিকে একটি পুষ্টিকর মাধ্যমে (Nutrient Media) রেখে এবং একটি বায়োরিয়েক্টরে কোষগুলিকে বৃদ্ধি করে মাংসে পরিণত হলে, সেই মাংসকে কেটে রান্না করে খাবার উপযুক্ত নাগেট তৈরি করে ব্যাবসা শুরু করতে যাচ্ছে। এবার কি দাঁড়ালো? প্রথমবারের মতো, পরীক্ষাগারে কালচার করা মাংস জনসাধারণের খাবারের জন্য বিক্রি করা যেতে পারে! শুনতে আশ্চর্য্য লাগলেও ঘটনা সত্যি।
এখন বিশ্বজুড়ে বিভিন্ন কোম্পানি খাবারের মেনুতে ল্যাব-ফলিত মাংস নিয়ে আসার লড়াইয়ে নেমে গিয়েছে। বুঝতেই পারছেন, আকর্ষনীয় বিজ্ঞাপনে থাকছে, “শুদ্ধ বিবেক নিয়ে মাংস খেতে পারেন”। এখানে কোন হত্যা নেই, জীবনের ধ্বংস নেই, রক্তপাত নেই, এ যেন উদ্ভিদের মতোই, পরিবেশের ক্ষতি কি তাহলে এখানেই ইতি? যারা পরিষ্কার বিবেক নিয়ে মাংস খেতে চান তাদের জন্য নিশ্চয়ই সুসংবাদ। বিশ্বে প্রতিদিন মানুষের খাবারের জন্য কোটি কোটি মুরগি, গরু, ছাগল, মেষ, শুকর এবং আরও কতপ্রাণী জীবন দেয় তার ইয়ত্তা নেই, এই অবস্থায় এই নূতন ব্যাবস্থা অভূতপূর্ব এবং অনন্য।
যারা খেয়েছেন তারা বলছেন স্বাদ এবং গন্ধে কোনই ব্যাবধান নেই, ব্যাবধান শুধু একটাই এটি ছিল হাড়বিহীন একটি মাংস পিণ্ড, ফিলের মত, তবে কোষগুলো একটু বড় মনে হয়েছে। প্রশ্ন হচ্ছে, চিত্তাকর্ষক এই প্রযুক্তি কতটুকু মানুষের রসনাকে জয় করতে পারবে? যুক্তরাষ্ট্রের কোম্পানি হলেও, ফুড এন্ড ড্রাগ ল্যাবরেটরির অনুমোদন পাওয়া সহজ নয় ভেবেই তারা সিংগাপুরের মত দেশে পাড়ি দিয়েছেন এবং সেখানে অনুমতিও পেয়েছেন। এসম্পর্কে সন্দেহের কোন অবকাশ নেই যে, এবার ল্যাবে এই মাংস তৈরিকে করতে হবে সম্পুর্ন নিয়ন্ত্রিত, পরিবেশবান্ধব এবং জীবাণুমুক্ত পরিবেশে। সিঙ্গাপুরে এটা অর্জন করা সম্ভব, জনপ্রিয় হলে ত কথাই নেই বিশ্বের অন্যান্য দেশে এলো বলে।
আপনাদের মনে প্রশ্ন আসতে পারে যে, এই মাংস যে পুষ্টিকর মাধ্যমে ল্যাবে রাখা হয় সেগুলো কিসের তৈরী? ভয়ের কোন কারন নেই, “ইট জাস্ট” জানিয়েছে এগুলো উদ্ভিদজাত খাদ্য উপাদান থেকে তৈরি করা হবে দ্রুতই। তবে একটু সমস্যা এখনো রয়ে গেছে তা হচ্ছে তারা দুই বছর আগে যখন সিংগাপুর ফুড এজেন্সিতে অনুমতি প্রার্থনা করে তখন তারা ব্যাবহার করেছিলো, গবাদি পশুর ভ্রূণের রক্তরস (Fetal bovine serum), তাই এখনো সেটি ব্যাবহার হচ্ছে তবে তা রান্নার আগেই পরিষ্কার করে সরিয়ে ফেলা হবে এবং অদূর ভবিষ্যতে বিভিন্ন উদ্ভিদ ব্যাবহার করার পদ্ধতি জানা হয়ে গেছে শুধুমাত্র অনুমতির অপেক্ষায়।
এটা সম্পর্কে সন্দেহের কোন অবকাশ নেই যে, অনেকেই এই শিল্পের বিকাশকে সাদরে গ্রহণ করবেন, বিশেষ করে পরিবেশবাদীদের বেলায় ত কথাই নেই। তবে প্রথম দিকে কিছু মানুষ ব্যাপারটা মেনে নিতে চাইবেন না বা মেনে নিতে সময় লাগবে। যারা মেনে নিতে চাইবেন না তাদের একটি দলের যুক্তি থাকবে, যদি মানুষ এই পশুকে হত্যা করে খাওয়া বন্ধ করে দেয় তাহলে ত পরিবেশের ভারসাম্য হারাবে। কোটি কোটি গরু, ছাগল, হাস, মুরগিদের ভিড়ে আর তাদের খাদ্য জোগাতে সভ্যতার অর্থনীতিতে বিরূপ প্রভাব পড়বে। এছাড়া রোগব্যাধির ব্যাপ্তিও হতে পারে, এসম্পর্কে আরও চিন্তা ভাবনা আর জ্ঞানার্জনের প্রয়োজন অস্বীকরা করা যায়না।
তবে যারা, ধর্মাশ্রয়ী তাদের কি হবে, সেটা নিয়ে আমি নৈতিক সংকটে আছি। সাধারণতঃ ধর্মাশ্রয়ীরা নূতন উদ্ভাবনীর সাথে তাল মিলাতে হিম শিম খেয়ে থাকেন। আমার মনে আছে ১৯৬৯ সালের ১৬ই জুলাই যখন এপোলো-১১ চাদে অবতরণ করলো সেদিন আমরা টেলিভিশনে দেখলাম, আমার বয়স তখন ১১ বছর। পরদিন পত্র পত্রিকায় বেরিয়েছিলো ধর্মাশ্রয়ীদের অবিশ্বাসী মতবাদ। ১৯৬৯ সালে যারা পিছিয়ে ছিলেন তারা আজো পিছিয়ে থাকবেন এতে সন্দেহ করার কোন অবকাশ নেই। প্রশ্ন হচ্ছে তাদের ব্যাখ্যা কি হবে সেটা দেখা। আমার মনে হচ্ছে প্রথমেই বলা যায়, এই মুরগী কিংবা গরু কিংবা খাসী জবাই করা হয়নি তাই এটা খাওয়া যাবেনা। অকাট্য যুক্তি, কথাটা ঠিকই যে, মুরগী কিংবা খাসীর মাংস ল্যাবের মাধ্যমে আমাদের নিকট আসবে সেই মুরগী তখনো কুক্কুরুক্কু ডাকছে কিংবা ম্যা ম্যা করছে, অর্থাৎ সেটা ত মরেনি, যে প্রাণী জবাই করে হত্যা করা হয়নি তার মাংস খাওয়া কি ঠিক হবে? প্রশ্ন হচ্ছে যে কোষটি নেয়া হয়েছে সেটা কিন্তু জীবিত নেই অর্থাৎ কোষ মরে গিয়েছে, এবং সেটা শুধুমাত্র কয়েকটা কোষকে ল্যাবে কৃত্রিম পদ্ধতিতে বৃদ্ধি করে মাংস পিণ্ড তৈরি করা হয়েছে, সেই হিসেবে মাংসের কোষগুলো মৃত, কিছুটা উদ্ভিদের মত, তাহলে সেই কোষ রান্না করা হলে খাওয়া যাবেনা কেন? এখানে একটি দল আছেন যারা বলবেন আল্লাহর নাম নিয়ে খেলে বাধা থাকবেনা। এগুলো গভীর জ্ঞানের বিষয় আমি যেভাবে হালকা আলোচনা করেছি সেভাবে করলে সঠিক হবেনা। তবে ধীরে ধীরে বিজ্ঞান যেদিকে এগিয়ে যাচ্ছে ততই আমরা নৈতিক সংকটে পড়ছি সেই কথা কিন্তু উড়িয়ে দেবার জো নেই। যেমন মনে করুন কোভিড-১৯ ভ্যাক্সিন নিয়ে কি কোন ধর্মাশ্রয়ী নৈতিক বিতর্ক হবে? ভাষ্কর্য্য নিয়ে ত বিতর্ক চলছে?
তথ্যসূত্রঃ উইকিপেডিয়া, দা গার্ডিয়ান্স, সিংগাপুর নিউজ, নিউ ইয়র্ক টাইমস