কোভিডঃ টিকা নিয়ে টোকাটুকি

ডাঃ জিন্নুরাইন জায়গীরদারঃ কোভিড ভাইরাস বিশ্বব্যাপী একটা ত্রাসের রাজত্ব প্রতিষ্ঠা করেছে, আজ বছর খানেক হতে চলল। কেউ কেউ এটাকে মহামারি না বলে বিশ্বমারি বলতে চাচ্ছেন। আনুষ্ঠানিকভাবে সংক্রমিত হয়েছেন প্রায় ৭ কোটি মানুষ আর মৃত্যুবরণ করেছেন ১৫ লক্ষ ৬০ হাজারের বেশী মানুষ, অনানুষ্ঠানিক সংখ্যা কয়েকগুণ হবার কথা। প্রত্যক্ষ সংক্রমণ আর মৃত্যু ছাড়া কোভিডের পরোক্ষ প্রভাব ভয়াবহ, সেটা আজ নাইবা আলোচনা করলাম। কোভিড আসার পরে এর চিকিৎসায় অন্ধভাবে আমরা অনেক ঔষধের যত্র তত্র ব্যাবহার লক্ষ্য করেছি কিন্তু প্রকৃত নিরাময় যোগ্য ঔষধ রয়ে গেছে এখনো ধরা ছোঁয়ার বাহিরে। প্রথম থেকেই কোভিড নিয়ন্ত্রণের জন্য লক ডাউন, ২ মিটার দূরত্ব, হাত ধূয়াধুয়ির উপর গুরুত্ব আরোপ করে ওয়ার্ল্ড হেলথ অর্গানাইজেশন, পরবর্তিতে মাস্ক পরার উপর গুরুত্ব আরোপ করা হয়। মহামারীর প্রথম ঢেউ শেষ হয়ে দ্বিতীয় ঢেউ চলছে, কিন্তু তাও তার শক্তি দুর্বল হওয়ার কোন লক্ষণ দেখা যায়নি। 

বিশ্বে ভাইরাস বাহিত রোগের চিকিৎসায় ঔষধের তেমন কোন সাফল্য আজো অর্জিত হয়নি, তবে এই রোগ প্রতিরোধে টিকার (ভ্যাক্সিন) কার্য্যকারীতা প্রতিষ্ঠিত। তাই প্রথম থেকেই বিজ্ঞানীরা টিকা আবিষ্কারের কাজে মনোনিবেশ করেন, বিভিন্ন দেশের সরকার এবং কোম্পানি টিকা আবিষ্কারে গবেষণার জন্য কোটি কোটি ডলার বিনিয়োগ করে।

করোনাভাইরাসের টিকা নিয়ে বিশ্বব্যাপি প্রথম থেকেই প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে যায়। চীনা বিজ্ঞানীরা যখন ১০ জানুয়ারি ২০২০ ভাইরাসের জিনোম আবিষ্কার করলেন, তখনই বিশ্বজুড়ে গবেষকরা টিকার ডিজাইন করা শুরু করে দেন। 

The coronavirus genome is like a shipping label that lets epidemiologists  track where it's been

মার্চ মাসে, করোনাভাইরাস ভ্যাকসিনের ক্লিনিকাল ট্রায়াল শুরু করে বিভিন্ন কোম্পানি এবং প্রতিষ্ঠান। এপ্রিলের মধ্যে ৮০ টির মত কোম্পানি এবং ১৯ টি রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান ভ্যাক্সিনের ট্রায়ালে সংযুক্ত হয়। ইতিমধ্যে ৩০০ টির বেশী প্রতিষ্ঠান ভ্যাক্সিন পরীক্ষায় কাজ করছে। যার মধ্যে এই মুহূর্তে চূড়ান্ত পর্যায়ে মানুষের উপর পরীক্ষা চলছে ১৩ টি টিকার এবং মানুষের উপরে মোট ৫৮ টি টিকা পরীক্ষা করা হচ্ছে। আরও কয়েক ডজন প্রকৃত পরীক্ষায় রয়েছে।

ভ্যাক্সিন রাজ্যে প্রথম টোকা দিল রাশিয়া। তারা নীতি নৈতিকতার চেয়ে সফলতাকে প্রাধান্য দিয়েছে কিংবা জপনগণের সুরক্ষাকে প্রাধান্য দিয়েছে বলা মুশকিল। ইতিমধ্যে রাশিয়া গত শনিবার থেকে গনটিকা প্রদানের কার্য্যক্রম শুরু করেছে। রাশিয়া তাদের নিজেদের তৈরি স্পুটনিক ভি ভ্যাক্সিন পরীক্ষা নিরীক্ষার তৃতীয় পর্য্যায় সমাপ্ত হওয়ার পূর্বেই জরুরী ভিত্তিতে জনগণের ব্যাবহারের জন্য সরকারী অনুমোদন দিয়ে পৃথিবীতে প্রথম অনুমোদনকারী রাষ্ট্র হিসেবে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করে, যদিও পশ্চিমা বিশ্ব এই কথা মানতে নারাজ। নারাজ হলে কি হবে রাশিয়া গত শনিবার আনুষ্ঠানিকভাবে গনটিকা প্রদান কর্মসূচী শুরু করেছে। রাশিয়ার গামালিয়া ন্যাশনাল সেন্টার গত ১১ই নভেম্বর পুরনো ধাঁচের ভেক্টর ভ্যাকসিন তৈরি করার ঘোষণা দেয়, যা শরীরে কোভিড ভাইরাসের স্পাইক প্রোটিন অন্তর্ভুক্তির জন্য সাধারণ ঠান্ডাজনিত অ্যাডেনোভাইরাসের দুর্বল সংস্করণ ব্যবহার করেছে। এই ভ্যাকসিনটিতে অ্যাডেনোভাইরাসের দুটি স্ট্রেন ব্যবহার করা হয়েছে এবং রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ানোর জন্য প্রথম ডোজের ২১ দিন পর দ্বিতীয় ডোজ দেয়ার প্রয়োজন হয়। ফাইজার এর অন্তর্বর্তীকালীন ফলাফল ঘোষণার দুই দিন পরে, ১১ই নভেম্বর — গামালিয়া তৃতীয় ধাপের পরীক্ষার একটি অন্তর্বর্তী বিশ্লেষণে প্রকাশ করে জানায় যে, স্পুতনিক ভ্যাকসিনের ৯২% কার্যকারিতা পাওয়া গেছে। এই প্রতিবেদনটি কেবলমাত্র ২০ জনের উপর পরীক্ষার উপর ভিত্তি করে তৈরি করা হয়েছিল, তবে বিশেষজ্ঞ অনেকেই এর কার্য্যকারীতা সম্পর্কে সন্দেহ প্রকাশ করেছেন। আগস্ট মাসেই, রাশিয়া স্পুটনিক ভি ভ্যাকসিনকে ব্যাপক ব্যবহারের জন্য অনুমতি দেয় এবং বাজারে এটি প্রথম নিবন্ধিত কোভিড-১৯ ভ্যাকসিন হিসাবে দাবি করেছে – ভ্যাকসিনের তিন স্তরের পরীক্ষা সমাপ্ত হওয়ার আগে এবং প্রাথমিক সময়ে প্রকাশিত যথেষ্ট প্রমাণের অভাব সত্ত্বেও, রাশিয়া তাদের ভ্যাক্সিনের অনুমোদন দিয়ে গনকার্য্যক্রম শুরু করে দেয়।

Second interim analysis of clinical trial data showed a 91.4% efficacy for  the Sputnik V vaccine on day 28 after the first dose; vaccine efficacy is  over 95% 42 days after the

পশ্চিমা বিশ্বে কোভিড টিকার রাজ্যে প্রথম অন্তর্বতীকালীন সাফল্যের ঘোষণা দানকারী ফাইজার বায়োনটেকের এম আর এন এ ভিত্তিক সম্পুর্ন নূতন ধরনের টিকা, দ্রুততার সাথে যুক্তরাজ্য প্রথম এই টিকার সরকারী অনুমোদন দেয় ২রা ডিসেম্বর ২০২০। পশ্চিমা বিশ্বে এটা ছিল প্রথম রাষ্ট্রীয় অনুমোদন। গতকাল মঙ্গলবার ৯০ বছরের বৃদ্ধা মার্গারেট কিনানকে টিকা প্রদানের মাধ্যমে যুক্তরাজ্য শুরু করেছে গন টিকা প্রদান কর্মসূচী। এই টিকা প্রস্তুত করেছে ফাইজার ও বায়োনটেক কোম্পানি যৌথভাবে। যুক্তরাজ্য ইতিমধ্যে ৮ লক্ষ টিকা সংগ্রহ করে গত ৮ই ডিসেম্বর আনুষ্ঠানিক প্রথম গনকর্মসূচী শুরু করার রাষ্ট্র হিসেবে তাদের দাবী প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করছে। বিশ্বের ইতিহাসে এম আর এন এ ভিত্তিক এটি প্রথম টিকা মানুষের জন্য ব্যাবহৃত হলো। 

Canada approves Pfizer-BioNTech vaccine

এই টিকা যুক্তরাষ্ট্রের কোম্পানি ফাইজার ও জার্মানির বায়োনটেক কোম্পানি যৌথভাবে আবিষ্কার করলেও যুক্তরাষ্ট্রের ফুড এন্ড ড্রাগ এডমিনিস্ট্রেশন (এফ ডি এ) এখনো এই অনুমোদন দেয়নি। ৯ই নভেম্বর প্রাথমিক ফলাফল ঘোষনা করে, ১৮ই নভেম্বর অন্তর্বতী সফলতার ঘোষণা দিয়ে ২০শে নভেম্বর তারা এফ ডি এ অনুমোদনের জন্য আবেদন করে। গতকাল এফ ডি এ সবুজ সংকেত দিলেও চূড়ান্ত অনুমোদন এখনো ঘোষণা করেনি। আশা করা যাচ্ছে আগামী বৃহস্পতিবার নাগাদ এই অনুমোদন পাওয়া যেতে পারে। যদি অনুমোদন পাওয়া যায় তাহলে যুক্তরাষ্ট্র এই মাসের শেষের দিকে বড় আকারের টিকা প্রদান কর্মসূচী শুরু করবে বলে অনেকেই আশা করছেন। তাই যুক্তরাষ্ট্র শুধু টুকি করেছে এখনো চূড়ান্ত টোকা দিতে পারেনি। এদিকে যুক্তরাষ্ট্রের মডার্না কোম্পানি ৩০শে নভেম্বর ৯৪.১% সফলতার ঘোষণা দিয়ে এফ ডি এ অনুমোদনের আবেদন করেছে, তারা আশা করছে আগামী ১৭ই ডিসেম্বর তাদের অনুমোদনের ব্যাপারে এফ ডি এ পর্য্যালোচনা শুরু করবে। 

চীন বেশ কয়েকটি ভ্যাক্সিণ নিয়ে চূড়ান্ত পর্য্যায়ে কাজ করছে। ইতিমধ্যে তারা রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে গনটিকা কর্মসূচী ঘোষণা না দিলেও তারা লক্ষাধিক মানুষকে টিকা দেয়া সম্পন্ন  করেছে বলে বিভিন্ন মাধ্যম থেকে জানা গিয়েছে। তাদের এডেনোভাইরাস ভিত্তিক টিকার তৃতীয় পর্য্যায়ের পরীক্ষা চলা অবস্থায় বাহরাইন এবং সংযুক্ত আরব আমিরাত জরুরী অনুমোদন দিয়ে গন টিকা প্রদান কর্মসূচি শুরু করেছে।

China Is Winning the Vaccine Race | Foreign Affairs

এদিকে সর্বাধিক আলোচিত এবং আশা জাগানিয়া যুক্তরাজ্যের অক্সফোর্ডের এম আর এন এ ভিত্তিক টিকার চূড়ান্ত পর্য্যায়ের ফলাফল বেশ ধাক্কা খেয়েছে। ২৩শে নভেম্বর প্রদত্ত তাদের অন্তর্বতীকালীন ফলাফলে ৭০% সাফল্যের কথা বলা হলেও প্রথম ডোজের অর্ধেক দেয়া নিয়ে কিছুটা সংশয় সৃষ্টি হয়েছে। 

Admission of mistake in Oxford vaccine dose raises doubts over reliability

এসব ভ্যাক্সিন সম্পর্কে আমাদের যথেষ্ট সন্দেহ থাকা অস্বাভাবিক নয়। বিশেষ করে এই টিকা কে আগে বাজারে আনতে পারে আর কে জনগণের কাছে পৌঁছে দিতে পারে সেটা নিয়ে প্রকাশ্য প্রতিযোগিতা চলছে। ভ্যাক্সিন নিয়ে যেহেতু কোটী কোটী টাকার মুনাফার সম্ভাবনা আছে তাই অর্থের নিকট জীবন আর নীতি নৈতিকতা কতটুকু স্থান পায় সে সম্পর্কে আমরা অবগত আছি। তবে, পশ্চিমা বিশ্বের স্বচ্ছতা আর নীতি নৈতিকতা অনেকটাই পরিচ্ছন্ন। তাই ফাইজার/বায়োনটেক এবং মডার্নার টিকার উপর অনেকটা ভরসা করা যায় কিন্তু রাশিয়া কিংবা চীনের টিকাগুলো কোনভাবেই মানদণ্ডে উচ্চতায় আসীন হতে পারে বলে মনে করার কোন অবকাশ নেই। অক্সফোর্ডের এস্ট্রা জেনেকার ভ্যাক্সিনের উপর বিশ্বের অনেক আশা ভরসা, আশা করা যায় তাদের টিকাও সহসা বাজারে আসবে। সবগুলো টিকাই এখনো তেমন কোন অত্যধিক পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া  প্রদর্শন করেনি বলে জানানো হয়েছে। যদিও যাদের এলার্জি আছে তাদের ফাইজারের টিকা এলার্জি করতে পারে বলে সাবধানবানী প্রকাশিত হয়েছে। ফাইজার-বায়োনটেক আর মডার্নার ভ্যাক্সিন দুটি ডোজ দেয়ার পর ৯৪-৯৫% সফল বলে দাবী করা হয়েছে। রাশিয়া আর চীনের ও এরকম সফলতার দাবী আছে কিন্তু প্রমাণ অপ্রকাশিত।

ফাইজার বায়োনটেকের টিকার জন্য -৭০ ডিগ্রি থেকে -৮০ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেডে অতি ঠাণ্ডায় সংরক্ষণ করাটা বেশ কষ্ট এবং ব্যায়সাধ্য তবে মডার্না কিংবা এস্টারজেনেকার টিকা সাধারণ ফ্রিজারের তাপমাত্রায় সংরক্ষণ করা সম্ভব।

এই টিকা প্রদান আনুষ্ঠানিক অর্থে শুরু হলো, এখন আমাদের দেখার পালা পশ্চিমা বিশ্ব কতদিনে নিজেদের জন্য সার্বজনীনভাবে এই পরিষেবার ব্যাপ্তি বৃদ্ধি করতে পারে আর কতদিনে তৃতীয় বিশ্বের জন্য এসকল টিকা উন্মুক্ত হয়। আমরা এখনো যা জানিনা তা হচ্ছে এসকল টিকা কতদিনের জন্য আমাদের সুরক্ষা দিবে? এর উত্তর পেতে হলে আমাদের আরও কিছুদিন অপেক্ষা করতে হবে। 

The Anxiety of Waiting is Hell, But It Doesn't Have To Be | by Lindy |  Medium
SHARE THIS ARTICLE