লেখক রহমান ফাহমিদা -(ষষ্ঠ পর্ব ও শেষ পর্ব)ঃ আজকে ভাইয়ার বিয়ের দিন।মায়াবী তাই অনেক সকালে উঠল।যদিও ওদের আত্মীয় স্বজন সব ঢাকায় থাকে তাই ওতো চিন্তা নেই।রাতে কেউ থাকেনি,সবাই যার যার বাড়ি চলে গিয়েছিল তবে বরযাত্রী হয়ে সবাই এক সাথেই যাবে।যেহেতু রাতে বিয়ে তাই বিকেলে সবাই আসবে।মায়াবীর বান্ধবিরা সবাই এক সাথেই পার্লারে সাজতে যাবে তাই সবাই বারোটার মধ্যে ওদের বাসায় চলে আসবে।তাছাড়া ফাহিম হয়তো ভাইয়ার শেরওয়ানী নিয়ে আসবে।কারণ যেখানে বানাতে দিয়েছিল সেই দর্জি দেরি করেছে ট্রায়েল নিতে।মিলা আপুর সব জিনিস কালকেই দিয়ে দেয়া হয়েছে।গয়নাটা আর ফুলের মালা ওরা নিজেদের সাথে করে নিয়ে যাবে।মায়াবী আজকে ফাহিমের পছন্দের কালারের শাড়ি পরবে,হাল্কা আকাশি কালার।তবে চুলগুলো ছাড়া রাখবে ঠিক করেছে।বড় একটা দুল পড়বে,মালা পড়বেনা কারন বড় দুলের সাথে মালা ভাল লাগবেনা দেখতে তাই।চোখে কাজল দিবে আর লিপিস্টিক দিবে,কপালে একটা বড় লাল টিপ পড়বে।হালকা মেকআপ করবে।
ভাইয়ার রুমের খাট সাজাতে লোকজন চলে এসেছে।অনেক ফুল এনেছে।মায়াবীর খুব ভাল লাগছে।যদিও রাতে একটু জ্বর জ্বর লেগেছে তবে সেই রকম না।বাইরের গেটে হইচই শুনে বুঝল ওর বান্ধবিরা চলে এসেছে।ও তাড়াতাড়ি ভাইয়ার রুম থেকে বের হয়ে দেখল যে সবাই চলে এসেছে বেনু,শেফালি,কেয়া,সবনম,মিতু সাথে জেরিনও আছে।ও সবাইকে নিজের ঘরে নিয়ে গেল আর বুয়াকে বলে গেল সবাইকে নাস্তা দিতে।ওরা সবাই নানান গল্প করল।বেনু মায়াবিকে বলল,তোর আর ফাহিমের বিয়েটা কবে খাব?বেনু দুস্টুমি করে আরও বলল,আজকে তোর আর ফাহিমের বিয়েটাও হয়ে গেলে মন্দ হতোনা!
মায়াবী বিশাল একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস ছাড়ল কারণ ওরা তো জানেনা মায়াবীর ক্যানসার হয়েছে আর ওর সময় খুব কম!তাই হেসে বলল,বিয়ে হলে ফাহিম আমাকে খাওয়াবে কি?
বেনু বলল,কেন ওর বাবার এত কিছু আছে,কে খাবে অতসব?
মায়াবী বলল,আমি নিশ্চয়ই চাইবনা আমার স্বামী কিছু করবে না,ওর নিজস্ব কোন পারসন্যালিটি থাকবেনা!
এমন সময় মা ডাক দিল মায়াবী মায়াবী,দেখ কে এসেছে?
মায়াবী বলল,আসছি মা।তারপর ওদের দিকে তাকিয়ে বলল,নিশ্চয়ই ফাহিম এসেছে ভাইয়ার কাপড় নিয়ে,চল যাই।সবাই মায়াবীর সাথে গেল।ফাহিম সবাইকে একসাথে দেখে বলল,কি ব্যাপার সব বিচ্ছু দেখি এক সাথেই আছো?ঘটনা কি?
মায়াবী বলল,তা তোমার জেনে কি হবে?তুমি যে কাজে এসেছ সেই কাজ কর।
ফাহিম বলল,আমার আর কি কাজ!আমার দুলাভাইয়ের কাপড় দিতে এসেছি,আন্টি মিষ্টি খেয়ে যেতে বল্ল তাই বসলাম শত হলেও তাঁর বউমার ভাই।
মায়াবি বলল,ঠিক আছে বসো।বান্ধবিদের দিকে তাকিয়ে বলল, তোদের একটা কাজ দেই চল।ভাবির কসমে্টিক্সগুলো একটু রেপিং করে ডালায় রাখবি।
ফাহিম বলল,আমার দুলাভাই কোথায়?
মায়াবী বলল,তিনি তার রুমে মনে হয় ঘুমাচ্ছে।
ফাহিম বলল,আজকে তার বিয়ে আর সে ঘুমাচ্ছে,স্ট্রেঞ্জ!যাই দুলাভাইয়ের সাথে দেখা করে আসি।আন্টিকে বলো,বুয়াকে দিয়ে দুলাভাই এর রুমে নাস্তা পাঠিয়ে দিতে।
মায়াবী বলল,ঠিক আছে।তারপর মায়াবী ওর বান্ধবিদের বলল,ভাবীর সব কাপরগুলো রেপিং করে ডালায় সাজাতে হবে।তোরা শুরু কর,আমি একটু আসছি।
মায়াবী রুমে এসে বুঝল,ওর কিছু অসুবিধা হচ্ছে তাই ও মুখ ধুতে গিয়ে দেখল নাক দিয়ে রক্ত পড়ছে,ও তাড়াতাড়ি বেসিন পরিস্কার করে দিল।তারপর অনেক্ষন ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদল।কেন এমন হচ্ছে!ফাহিমকে দেখলেই ওর বুকের ভেতর থেকে কান্না চলে আসে।এমন সময় কেউ মনে হয় ঢুকল রুমে।জেরিনের গলা শুনতে পেল।জেরিন বলছে মায়াবি স্কচটেপ কোথায়?তার কিছুক্ষণের মধ্যে ফাহিমের গলা শুনতে পেল।মায়াবী তাড়াতাড়ি দরজা খুলে দেখে ফাহিম জেরিনকে পেছন থেকে গলা জরিয়ে ধরে আছে।
মায়াবীর এই দৃশ্য দেখার পেছনে কারণ হোল,ফাহিম মায়াবীর জন্য একটি বেলি ফুলের মালা পকেটে করে নিয়ে এসেছিল তাই সুযোগ বুঝে মায়াবীকে পড়িয়ে দিবে বলে ওর রুমে এসেছিল।যেহেতু সন্ধ্যা হয়ে আসছে আর মায়াবী লাইট অন করেনি তখনও,তাই ফাহিম বুঝতে পারেনি এটা মায়াবী না জেরিন ছিল।ফাহিম মায়াবীর বাথরুমের দরজার আওয়াজ শুনে তাকিয়ে দেখে মায়াবী ওর দিকে তাকিয়ে আছে,ফাহিম যাকে ধরে ছিল সে জেরিন।ফাহিম এক লাফ দিয়ে তাড়াতারি জেরিনকে ছেড়ে দিয়ে সরি সরি বলতে বলতে বের হয়ে চলে গেল।জেরিন মায়াবির দিকে তাকিয়ে হাসতে হাসতে বলল,ফাহিম কেমন ডস খেলো।তোকে মনে করে আমাকেই জরিয়ে ধরেছিল।আমি তোর রুম থেকে স্কচটেপ নিতে এসে টিপস পেয়ে গেলাম।এই বলে বেহায়া মেয়ের মত হাসতে হাসতে চলে গেল।মায়াবী ওর চলে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে ভাবল,এরকম মেয়ে আর দেখেনি জীবনে।বেনু জেরিনকে খুঁজতে এসে সব ঘটনা শুনল।মায়াবী ওর কাছে কেঁদে দিল,বেনু শান্তনা দেয়ার ভাষা খুঁজে পেলনা।মায়াবী ভেবেই পেলনা,এতদিনের চেনা পরিচয় থাকা সত্ত্বেও ফাহিম কি করে বুঝলনা,এটা মায়াবী না,জেরিন।পেছন থেকেই তো বুঝার কথা!
মায়াবী সেদিন আর পার্লারে গেলনা শরীর খারাপ লাগছে বলে।তাই বান্ধবীরা সবাই চলে গেল।মা বাবা অস্থির হয়ে পড়ল এই ভেবে,কি হল আবার!ভাইয়াও কয়েকবার এসে খোঁজ নিয়ে জানতে চাইল,ওর শরীর খারাপ লাগছে কিনা!ও বলল,একটু জ্বরজ্বর লাগছে কিন্তু তেমন কিছু না ওষুধ খেলেই ঠিক হয়ে যাবে।তাই বাসার থেকেই রেডি হয়ে যাবে।মা এসে ওষুধ খাইয়ে দিল।মায়াবী শাড়ি পড়ে নিজেই হাল্কা সাজ দিয়ে বিয়ে বাড়ি গেল।হোটেল রেডিসনে বিয়ে হয়েছে।
ফাহিম বার বার ওর কাছে এসে সরি বলছে,আর বলছে তখন সন্ধ্যা হয়ে গিয়েছিল এবং লাইট জালানো ছিলনা তাই তোমাকে চিনতে পারিনি।আমাকে মাফ করে দিও, জান।
মায়াবী ভাবল,ওতো বেশি হলে আর এক মাস আছে ক্ষমা না করে কি করবে!তাই ফাহিমকে বলল,ক্ষমা করতে পারি এক শর্তে রোজ আমাকে লাল গোলাপ এনে দিবে কিন্তু গোলাপের রঙ হতে হবে রক্তের মত লাল।
ফাহিম বলল,ঠিক আছে দিব।আজকে তোমাকে খুব সুন্দর লাগছে।
মায়াবি বলল,অনেক ধন্যবাদ।
বিয়েতে মিলা আপু আর ভাইয়াকে খুব সুন্দর লাগছিল।অনেক রাত হয়ে গেল বাসায় ফিরতে।ভাইয়া ভাবিকে বাসরঘরে ঢুকিয়ে দিয়ে ঘুমাতে ঘুমাতে অনেক রাত হয়ে গেল।যেহেতু মায়াবীর শরীর ভালো না তাই আজকে ওর সাথে ওর মা ঘুমালো।মায়াবী রাতে সেজন্য মোবাইল অফ করে রেখেছিল ফাহিম যেন কল করতে না পারে।তাহলে মা বুঝে যাবে ওদের মধ্যে অন্য রিলেশন আছে।শেষ মুহূর্তে এসে ধরা খেতে চায়না।পরেরদিন বৌভাত,তাই সকাল সকাল উঠতে হবে।ওরা তাই ঘুমিয়ে পড়ল।
বউভাতের দিন অনেক হুলুস্থল হল।ভাবি আর ভাই আজকে ফাহিমদের বাসায় থাকবে।তাই ভাবি গোছগাছ করছে।খেতে বসে মায়াবি ভুলে করে একবার মিলা আপু বলে ফেলেছে সেজন্যে মামা ওকে দিয়ে একনাগারে দশবার ভাবি বলিয়েছে।যেন আর ভুল না হয়।মা তা দেখে খুব হেসেছে।মামা ভাইয়ার হলুদ থেকেই ওদের বাসায় আছে।নানা নানি তাঁদের বাসা খালি বলে চলে গেছেন।মামা বলছিল ভাই এর সাথে তো বোন যায়,মামা আমাকে বলল,তুই যাবিনা?
মা বলল,ওর শরীর ভালো না,তাছাড়া সবাইকে মেঘ চেনে ওর অসুবিধা হবেনা।মিলা তো একাই এসেছে।মামা মাকে ধমক দিয়ে বলল,আপা,তুমি ওতো মিলা মিলা করছ,বউমা বলতে পারো না।বউ মা বল দশ বার,তাহলে অভ্যাস হয়ে যাবে।মায়াবি বলল খুব মজা,আমার সময় হেসেছ এখন তুমিও দশবার বল মা।
ভাইয়ার বিয়েটা হয়ে গেল।মায়াবি বুঝল,বাবা মা আর ঐ বাড়ির সবাই মিলে মায়াবির আশা পুরন করার জন্যই এত তারাতারি বিয়েটা দিল।যাই হোক মিলা আপু থুড়ি ভাবি খুব ভালো।মায়াবীর এভাবেই দিনগুলি কেটে যাচ্ছিল কোনরকমে একটা ভয় আর আতংকের মধ্যে।একদিন মায়াবী অন্ধকার করে ঘরে বসে ছিল আর ফাহিমের আর ওর স্মৃতিগুলো মনে করছিল।সেই ছোটবেলা থেকে ফাহিমের সাথে পরিচয়।কিভাবে যেন একজন আরেকজনকে ভালো লাগতে শুরু করল আর সেই থেকে কেমন করে যেন ভালোবাসায় জড়িয়ে গেল!কত যে ঝগড়া হয়েছে দুজনের মধ্যে,আবার ভাবও হয়েছে।একটি কৎবেল এক কাঠিতে দুজনে খেত আবার এক স্ট্রতে কোক পান করতো।এখন আর তেমন করে খাওয়া হয় না।ফাহিমের সাথে ওর অনেক অনেক স্মৃতি যা কখনই ভোলার নয়!
এরই মধ্যে কেমন করে যেন দুই মাস চলে গেল!আর একটি মাস আছে ওর হাতে। ভাইয়ার রেজাল্ট দিবে খুব শ্রীঘ্রই তাই ওরা দেশের বাইরে না যেয়ে হানিমুন করতে কক্সবাজার গেল।যাওয়ার আগে অনেক করে বলেছিল সবাইকে নিয়ে যাবে কিন্তু মায়াবীর শারিরিক অবস্থা ভালো না তাই সবাই যাওয়া ক্যানসেল করল।ফাহিম রোজ মায়াবিকে কল করে আবার প্রতিদিন দেখাও করে।আগের মতই ব্যবহার করে মায়াবীর সাথে,তবে মায়াবির মনে হয় কোথায় যেন ফাটল ধরেছে ওদের সম্পর্কের মধ্যে।মায়াবি ফাহিমের কথা চিন্তা করতে করতে ঘুমিয়ে পড়ল।হঠাৎ করে কার যেন চোখের পানি ওর মুখে পড়ল ও জেগে উঠল।উঠে দেখে মা আর বাবা দুজনেই ওর বিছানার পাশে বসে আছে।মা ওর কপালে হাত দিয়ে কাঁদছে আর বাবা ওর হাত ধরে বসে আছে।মায়াবী বুঝতে পারল আজকে হয়তো দুজনে ওর অসুখের কথা বলবে,তাই এসেছে ওর ঘরে।কিন্তু মায়াবি যে অসুখের কথা জানে তা বুঝতে না দিয়ে বলল,কি ব্যাপার!তোমারা দুজন একসাথে,কিছু বলবে?ব্যাংককের রিপোর্ট কি এসেছে?
ওর প্রশ্ন শুনে মা বাবা দুজনেই কেঁদে দিল।বাবা তারপর সব কিছু খুলে বলল,সেই ইন্ডিয়ার রিপোর্ট থেকে শুরু করে সব।মায়াবি চুপ করে সব শুনলো এবং একটুও ঘাবড়ালোনা কিন্তু মাকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেলল।মাও ওকে জরিয়ে ধরে আরও জোরে কাঁদতে লাগল।
বাবা বলল,আমরা তো কারো সাথে কোন অন্যায় করিনি তবে আল্লাহ আমাদের এত বড় শাস্তি কেন দিলরে মা!তুই নিশ্চয়ই ভাল হয়ে যাবি।আল্লাহ সহায় হলে মীরাকেল হতে কতক্ষণ।আমরা আগেই জানতাম তোর অসুখের খবর কিন্তু এত তাড়াতাড়ি তোকে বলতে চাইনি।তুই শখ করেছিলি তাই মেঘেরর বিয়ে দিলাম,শুধু তোর খুশি দেখার জন্য,আর কিছু না।তুই নিজেকে শক্ত কর মা।
কথাগুলো বলতে বাবার খুব কষ্ট হচ্ছে দেখে মায়াবি বলল,আমি শক্ত আছি মানসিক দিক থেকে।তোমরা জানলে কষ্ট পাবে তাই এই কষ্ট আমি একা একাই বহন করেছি, প্রথম থেকেই।যেদিন ফয়েজ চাচা এসে প্রথম সব বলে গেল,সেদিন থেকেই আমি সব জানি।মা আর বাবা হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে রইল মায়াবীর দিকে।আর দুজনেই ভাবল,মায়াবি কবে এত বড় হয়ে গেল!নিজের কষ্টটাকে ছাই ছাপা দিয়ে রেখেছিল এই দুইমাস।কাউকে কিছুই বুঝতে দেয়নি।বাবা মা ওকে জরিয়ে ধরে কাঁদতে লাগলো।বাবা কেঁদে কেঁদে বলল,মারে তোকে ছাড়া আমরাও বাচঁবোনা,আল্লাহ কোন না কোন সময় সবাইকে নিবেন,তোর সাথে যেন আমাদের নিয়ে যায় এই দোয়া করি।এই বলে দুজনে কাঁদতে কাঁদতে মায়াবীর রুম থেকে চলে গেল।
মায়াবী একা ওর ঘরে অন্ধকারে চুপচাপ বসে রইল।ওর এখন কত কিছু করা বাকি,এই একমাসে ও কি করবে তা বুঝতে পারছেনা।বেনুকে বলবে ওর অসুখের কথা!না,বলবে না তাহলে বেনু খুব কাঁদবে।তা ও সহ্য করতে পারবে না বেঁচে থেকে,মরে গেলে অন্য কথা।একটা কাজ করা যায়।ওদের বাড়ির পাশে লাল বাড়িটায় অনেক কামরাঙ্গা ধরে আছে,বেনুর সেই কামরাঙ্গাগুলো খাওয়ার শখ।মায়াবী চেষ্টা করবে সেই কামরাঙ্গাগুলো পেরে ওকে দিতে।আর একটা শখ পালন করবে বেনুকে নিয়ে তা হল একদিন রাতে ওর বাসায় থাকবে,মায়াবীর মা অন্য সময় হলে হয়তো না করতো তবে এখন থাকতে দিবে,তাই ওর ওখানে গিয়ে সিদ্দিকা কবিরের রান্নার বই নিয়ে দুজনে রান্না করে খাবে কারন ওরা দুজনেই রান্না পারেনা।ওর আরেকটি সখ ছিল ফাহিমের কাছে গীটার শিখার।কেননা ফাহিম খুব সুন্দর গীটার বাজায় কিন্তু এই এক মাসে কি গীটার শেখা যাবে!মনে হয় না।ওর বুক সেলফে অনেক অনেক বই পড়া হয়নি।প্রতিবার বই মেলা থেকে অনেক বই কেনা হয় কিন্তু সব একবারে পড়া হয়না।এবার চলে যাওয়ার আগে বেছে বেছে কয়েকটা বই পড়বে।ভাইয়া ভাবিকে বলে যাবে,ও চলে গেলে,ওদের ঘরে যদি কোন পরীর মত মেয়ে হয় তাহলে যেন নামটা মায়াবী রাখে।কারন ওর নামটা ওর কাছে খুব প্রিয়।তা হারাতে দিতে চায়না।সবার মাঝে মায়াবী থাকবে তাহলে।মানুষ মরে গেলে সব পরিচয় ছাপিয়ে লাশ নামটা প্রাধান্য পায় কিন্তু মায়াবী ওর নামটা নিয়ে বেঁচে থাকতে চায়।আরেকটা কাজ করবে বাবাকে বলে,বুঝতে পারছে বাবা রাজি হবেনা কিন্তু ফাহিমের জন্য ও এই কাজটি করে যাবে তা হল ওর চোখ দুটি আই হসপিটালে দিয়ে যাবে,যেন অন্য কারো মাঝে চোখ দুটি দেখতে পায়।হয়তো কোননা কোন সময় ফাহিমকে চোখ দুটি দেখতে পাবে।
ফাহিমের সাথে জেরিনের ঐ ব্যাপারটার পর যদিও মায়াবী বলেছিল যদি রোজ ওকে একটা করে লাল গোলাপ দেয় তাহলে ও ফাহিমকে মাফ করে দিবে কিন্তু ফাহিম কথা দিয়েও কথা রাখেনি!কারন ওর প্রোফাইল গিয়ে পোস্ট দেখে আর চেক করে কে কত লাইক দিল আর লাভ স্টিকার দিল তা নিয়ে ফাহিমের সাথে ওর ঝগড়া লাগছে তাই ফাহিম বলেছে ওকে ব্লক মেরে দিবে কারন এসব ওর ভাল লাগেনা।শুধু ভাইবারে কথা বলবে।মায়াবির কেন যেন মনে হয় ফাহিম জেরিনকে এক্সেপ্ট করে নিয়েছে তাই ওকে ব্লক মারতে চাইছে।একদিন ফাহিম এক মেয়েকে লাভ স্টিকার দিয়েছে আর কমেন্টে ডিয়ার ফ্রেইন্ড লিখেছে বলে মায়াবি ওর সাতে ঝগড়া করেছে,বলছে মেয়েটাকে কেন ডিয়ার ফ্রেইন্ড বলেছো?ফাহিম বলেছে,মেয়েটাই ওকে আগে বলেছে তাই ও বলেছে।মায়াবী বলেছে,ও বললেও তুমি বলবে কেন?মায়াবির ফাহিমকে চার্জ করা ঠিক হয় না কারন ওতো পৃথিবীতে বেশি দিন নেই।তারপরেও ভুলে যায়!আর চার্জ করে।ফাহিম ওকে চার্জ করা পছন্দ করেনা,তাই এ নিয়ে ওদের মনোমালিন্য শুরু হয়।
বেনু একদিন কল করে মায়াবীকে জানালো,ফাহিমের সাথে জেরিন কলেজে গিয়েছিল। ফাহিমের কাছে জানতে চাইলে ফাহিম বলল,আমার পেছনে কি গোয়েন্দা লাগিয়েছো। তাহলে খুব খারাপ হবে কিন্তু!তুমি আমাকে সরাসরি জিগ্যেস করতে,আমি না বললে তখন দেখতে।তুমি আমাকে না জিগ্যেস করে সরাসরি আমাকে ব্লেই্ম দিয়ে দিলে!ঠিক আছে আমি সেদিনের ঘটনাটি বলছি,আমি আসছিলাম দেখলাম জেরিনদের গাড়ি পাংচার হয়ে গিয়েছে।তাই আমাকে দেখে ও ডাকল,আমি ওর ডাক শুনে পেছনে তাকিয়ে দেখি ওর নানা আর জেরিন দাঁড়িয়ে আছে।আমি এখন কি করতে পারি,ওর নানার সামনে।আমি ওদের কাছে গেলাম আর জেরিন আমার বাইকে বসে নানাকে বলল,আমার কলেজে দেরি হয়ে যাচ্ছে,আমি চললাম।নানা তুমি গাড়ী ঠিক করে বাসায় যেও।ওর নানা আমাকে শুধু বলল,ওকে নামিয়ে দিও ভাই।এখন তুমিই বল আমার কি করার ছিল?মানুষের বিপদে সাহায্য করা কি অন্যায়?এর পর থেকে ফাহিম প্রায়ই ওকে এড়িয়ে চলে,বলে পরীক্ষা নিয়ে ব্যস্ত কিন্তু ওতো জানে মায়াবী বেশি দিন নেই! তবে কেন ওকে সময় দিচ্ছে না।আজকাল প্রতিদিন কথাও হয়না।ফাহিম এত রাগ করেছে যে,কল দিয়ে কথা বলতে চায় না।মায়াবী যখন ওকে জিগ্যেস করল,তুমি কল দেওনা কেন?ও তখন বলে,কল দিয়ে কি হবে!প্রতিদিন কল দিলে,ঝগড়া লাগে।তারচেয়ে বরং দুই তিনদিন পর পর কল দেয়া ভাল।তখন অনেক কথাও বলা যায়।মায়াবী বলতে পারেনা যে,ওর সাথে কথা না বললে মায়াবীর ভালো লাগেনা।ফাহিমকে ও এখন অনেক মিস করে!ওকে হারানোর ভয়ে না,মায়াবী একদিন নিজেই যে হারিয়ে যাবে,সেই ভয়ে।
মায়াবীর মাঝে মাঝে ঘুম আসেনা।ফাহিম কল করলে কথা বলে তা না হলে না।কারণ ও নিজেও বুঝে গেছে,ফাহিমের জন্য ওর প্রতিটি নিঃশ্বাসে যে ভালোবাসার প্রদীপ যতন করে রেখে দিয়েছে তা আস্তে আস্তে নিভে যাচ্ছে।তাই আজকাল আর ফাহিমের কোন ব্যাপারে নাক গলাতে চায়না,যদিও ওর অনেক কষ্ট হয়,তবুও ও দূরে সরে থাকতে চায়।এখন ও খুব কম ফেসবুক ওপেন করে।যখন ওপেন করে তখন শুধু অন্যের পোষ্ট দেখে,নিজে কোন পোস্ট দেয় না।যদি কোন পোস্ট ভালো লাগে তাহলে শেয়ার দেয়।যেমন, সেদিন ওর একটি পোস্ট ভাল লাগছে তাই শেয়ার দিল।পোস্টটি ছিল এরকম-
১। কিছু কিছু মানুষ গভীর রাত পর্যন্ত অপেক্ষা করে তার প্রিয় মানুষটির কোন কল অথবা একটা ম্যাসেজ এর জন্য।
২। কিছু কিছু মানুষ না ঘুমিয়ে অতীতের ডায়রির পাতা খুলে বসে।
আর শেষ রাতের ভালোবাসার সেই ক্ষণগুলো কল্পনা করে।
৩। কিছু মানুষ ফোনে পুরনো ম্যাসেজ এর মিথ্যে লাইনগুলো দেখে অঝোরে চোখের পাতা ভেজায়।এই মানুষগুলো রাতে ঘুমায় না।
আসলে ঘুম আসেনা!
রাতের ঐ তাঁরারাও উপহাস করে আজ বলে,তুমি একা সত্যি ভীষণ একা তুমি।
এই পোস্টটির প্রতিটি কথা মায়াবীর বর্তমান পরিস্থিতির সাথে মিলে যায়।ফাহিমের জন্য মায়াবীর এই অনুভূতিগুলো হয়।নিজেকে খুব অসহায় মনে হয় এবং একা একা লাগে,সবাই চারিপাশে থাকা সত্ত্বেও।সবচেয়ে খারাপ লাগে ফাহিম যখন জেনে শুনেও ওকে অবহেলা করে।ওতো এই পৃথিবীর আলো আর বেশিদিন দেখবেনা তবে কেন ফাহিম ওর সাথে এমন করছে!এমন কি করেছে ও?যা মনে এসেছে তা ফাহিমকে বলেই দিয়েছে।মায়াবীর তো রাগ হতেই পারে।ফাহিমকে ও অনেক অনেক বিশ্বাস করেছিল কিন্তু ফাহিম!আজকে মায়াবীর গলায়,সেই বিশ্বাস গলায় ফাঁস হয়ে বসে আছে।
বাসার সবাই আজকাল ওর সাথে আগের মত আচরণ করছেনা মনে হচ্ছে অনেক বেশি বেশি আদর করছে।যা ওর কাছে করুনা মনে হচ্ছে।কারণ এখন আর মা আগের মত ওকে বকেনা।ভাইয়ার কাছে যা চায় তাই পায়,ভাইয়া আগের মত ওর সাথে খুনসুটি করেনা।বাবাও পড়ার জন্য কোন চাপ দেয়না!কারণ বাবার,মায়াবীকে নিয়ে ডাক্তার বানানোর আশা যে শেষ হয়ে গেছে।মামা এসেও আগের মত উপদেশ দেয়না শুধু ফ্যালফ্যাল করে ওর দিকে তাকিয়ে থাকে,মায়াবীর সাথে চোখে চোখ পড়লেই চোখ সরিয়ে নেয়।মায়াবীর ভালো লাগেনা এসব।ফাহিমও সুযোগ বুঝে দূরে সরে গেল!তা নাহলে এমন কি হয়েছিল ও নিজেই তো দোষ করেছিল।এত ভালবেসে কি করে সব ভুলে গেল।সবই কি অভিনয় ছিল!
নিজের চেয়ে মায়াবীর আজকাল সবার জন্য এমনকি ওর ঘরের সব কিছুর জন্য মায়া লাগছে।প্রায়ই মায়ের বুকে ছোট বেলার মত করে মুখ লুকিয়ে শুয়ে থাকে।মায়ের সাথে মিষ্টি একটা গন্ধ মায়াবীকে পাগল করে দেয়।।প্রত্যেক মায়ের সাথেই মনে হয় এরকম মিষ্টি ঘন্ধ থাকে।বাবা এখন অফিস থেকে তাড়াতাড়ি চলে আসে।মায়াবীকে সময় দেয়।বাবার সাথে বসে মায়াবী অনেক গল্প করে।বাবা এত কথা বলতো না এখন মনে হয় মায়াবীর কাছে তাঁর রাজ্যের গল্পের ঝাঁপি খুলে বসে।মায়াবী এখন প্রায়ই ভাইয়া আর ভাবির সাথে ঘুরতে যায়।কখনো কখনো ফাহিমও সাথে থাকে।ফাহিম এখন আর আগের মত ওদের বাসায় ঘন ঘন আসেনা কারণ এখন বোনের শ্বশুর বাড়ি হয়ে গেছে মায়াবীদের বাড়িটা।তাই ওর মা বলেছে এত ঘন ঘন ঐ বাড়িতে যেতে নেই।মা তো আর জানেনা,মায়াবীর সাথে ফাহিমের কি সম্পর্ক!সবার এত আদর আর ভালোবাসা দেখে মায়াবির বেঁচে থাকতে ইচ্ছে করে।যতই দিন যাচ্ছে আর পৃথিবীর প্রতি টান আরও বাড়ছে।সবার প্রতি মায়া ওকে পেয়ে বসছে।
কেউ যেন বুঝতে না পারে মায়াবীর কিছু হয়েছে,তাই মাঝে মাঝে ফেসবুকে মজার মজার জোকস শেয়ার করে।যদিও মায়াবী এখন আর সেভাবে পরালেখা করে না তবুও ওদের গ্রুপিংএ বায়োলজি বা কেমিস্ট্রির অংক সমাধান করতে দেয়।সামনে পরীক্ষা মায়াবী যেহেতু টেস্টে খুব ভাল রেজাল্ট করেছে তাই ও পড়ালেখা করছে তা বোঝাতে এই অংক দেয়।মায়াবী জানে ওর পরীক্ষা দেয়া হবেনা তার আগেই হয়তো চলে যেতে হবে।তাই মজা করার জন্য,মাঝে মাঝে বন্ধুদের প্রেমের খবর নেয়।একদিন কেয়া জেরিনের কাছে জানতে চাইল,জেরিন কারো সাথে প্রেম করে কিনা!জেরিন বলল,ও এখনো কারো সাথে তেমনভাবে প্রেমের সম্পর্কে জড়ায়নি তবে অনেক ছেলেকে নাচাচ্ছে।যদি কখনো কারো প্রেমে পড়ে তবে তাকে সোনার ব্রেসলেট দিয়ে বরণ করে নিবে।
কেয়া বলল,যে তোকে ভালোবাসে তাকে এভাবে নাচাইস না।তোর এসব দেখে ফেসবুকের একটা পোস্ট মনে পড়ে গেল,যেমন-
যে তোমাকে পাগলের মত ভালোবাসে,
তাকে কখনো ছাগলের মত অবহেলা করো না।
হয়তো একদিন তুমি তাকে গরুর মত খুঁজবে,
কিন্তু সেদিন সে তোমাকে বানরের মত নাচাবে।
কেয়ার কথা শুনে গ্রুপের সবাই হেসে দিল।
চারদিন পর ভ্যালেন্টাইনস ডে।মায়াবী ঠিক করলো সেদিন সারাদিন ফাহিমের সাথে কাটাবে কারণ এটাই শেষ ভ্যালেন্টাইনস ডে।তাই মায়াবী নিজের জমানো টাকা দিয়ে দামী একটা ঘড়ি কিনল ফাহিমের জন্য।সেদিন ফাহিমকে ঘড়ি দিবে,টি সার্ট কিনে দিবে এবং লাঞ্চ ডিনার করবে এক সাথে।তাই রাতে মায়াবী কল করে ফাহিমকে জানাল।ফাহিম বলল,ঠিক আছে,আমি সেদিন সারাদিন তোমার জন্য সময় বরাদ্দ রাখব,জান পাখি।আজকে ফাহিমের মুড ভালো আছে তাই অনেক রাত পর্যন্ত কথা বলল।কল রাখার সময় বলল,তুমি এখন ঘুমাও,আমিও ঘুমাতে যাই।মায়াবী যখন বলল,ওর ঘুম আসেনা তখন ও বলল,চোখ বন্ধ কর আর আমাকে ভাবো,মনে কর তুমি আমার বুকের ওপর মাথা রেখে ঘুমিয়ে আছো।দেখবে ঘুম চলে আসবে।আমি তোমার কপালে চুমু দিয়ে দিলাম।লক্ষ্মীটি,কালকে আবার কথা হবে।লাভ ইউ।গুড নাইট।
মায়াবী প্রতিদিন দিন,তারিখ সব গুনে,এইভেবে আর কতদিন ও আছে এই পৃথিবীতে।এক একটা দিন চলে যায় আর মায়াবী দিন গুনতে থাকে।এর মধ্যে মায়াবীর দুইবার ব্লাড দিতে হয়েছে।ওর ব্লাড গ্রুপও রেয়ার।তাই সন্ধানী ও রেট ক্রিসেন্টে ভাইয়া ও বাবা মেম্বার হয়ে এসেছে যদি ওদের রক্তের পরিবর্তে যদি ওনেগেটিভে রক্ত পাওয়া যায়।রক্ত পেলেই তা দেয়া যায়না সেজন্য মায়াবীর রক্তের সাথে ক্রসম্যাচিংও হতে হয়।
মায়াবী এখন ফাহিমের সাথে কম বাইরে যায় কারণ সামনে পরীক্ষা তাই ফাহিমের পড়া লেখায় ডিস্টার্ব করতে চায়না।ফাহিমের সাথে কথা কম হয়।যদিও ফাহিম বলে কথা কম হলে যে টান থাকবেনা,তা নয়!মায়াবী তা হারে হারে টের পায় কারণ ও সারাদিনই ফাহিমের চিন্তায় মগ্ন থাক।যা দেখে তার সাথেই ফাহিমকে মিলাতে ট্রাই করে।
ভ্যালেন্টাইন ডে নিয়ে মায়াবী খুব এক্সাইটেড আছে।আবার চিন্তায়ও আছে এই ভেবে যে ভ্যালেন্টাইন ডে আসার সাথে সাথে ওর মৃত্যুর দিনও কাছে চলে আসবে!তাই ভাল লাগেনা কিছুই।যখন অসুখের কথা জানেনি তখনি তো ঠিক ছিল।জেনে গিয়েই শত ঝামেলা পোহাতে হচ্ছে।মাঝে মাঝে খুব হতাশ হয়ে পড়ে।আশেপাশের মানুষ আর পরিস্থিতি দেখে মনে হয়‘মরে গেলেই বুঝি বেচে যেত’কিন্তু মরে যাওয়ার কথা ভাবলে আবার চোখের কোণ আপনাআপনি ভিজে যায়,নিজেকে তখন সামলাতে পারেনা।অঝোর ধারায় কাঁদতে থাকে।রাতে যখন ঘুম আসেনা তখন ভাবে ওর মৃত্যু কিভাবে হবে,ধুঁকে ধুঁকে মরবে নাকি হুট করে মরবে।না,এত এক্সিডেন্ট হচ্ছে,সেই এক্সিডেন্টে মারা যাবে।কিছুই ভাবতে পারছেনা।বাঁচার ইচ্ছাটা যখন প্রবল হয়ে দেখা দেয় সে তখন মরতে ভয় পায়।আজকাল কেন জানি দাদা দাদিকে স্বপ্নে দেখে কিন্তু ও কখনো তাঁদেরকে বাস্তবে দেখেনি!শুধু ছবি দেখেছে।মায়াবী জন্ম নেয়ার আগেই তাঁরা নাফেরার দেশে চলে গেছেন।মায়াবী ইদানিং ফেসবুকে দেখছে একটি ছেলে কানের কি এক অসুখের কারনে অসহ্য যন্ত্রনা সহ্য করতে না পেরে সব কিছু চিরকুটে লিখে চলে গেল মানে সুইসাই্ড করল।একটি মেয়েও একতরফা ভালবেসে ছেলেটিকে না পেয়ে সুসাইড করল!এরকম অনেকের কথা মনে হয়।তবে মায়াবির কাছে সুইসাইড করাকে, পরাজয় বরণ করে নেয়া মনে হয়।কারন আল্লাহ এত সুন্দর করে প্রত্যেক মানুষকে বানিয়েছেন,সে কেন সময় না হলে নিজের ইচ্ছায় অন্যের জন্য তার নিজের জীবন শেষ করে দিবে!তা মায়াবী হেইড করে।কারণ প্রতিটি মানুষের নিজের জন্য বাঁচার অধিকার আছে।তাছাড়া অনেক সময় দেখা যায় যে,প্রেমে ছেঁকা খেয়ে অনেকেই নিজের হাত কাটছে বা সিগারেট দিয়ে পুড়ছে,এগুলো কিছুতেই মেনে নেয়া যায়না।এসব ভীষণ অন্যায় কাজ।শুধু শুধু নিজের ওপর টর্চার করা।
রাত বারটা বাজে।মায়াবী ফাহিমকে ভ্যালেন্টাইন ডে এর শুভেচ্ছা ও ভালোবাসা জানালো।আজকে মনে হয় ফাহিমের মুড ভালো ছিল তাই ফাহিম মজা করে কথা বলল।ফাহিম বলল,শুধু শুভেচ্ছা জানালেই হবেনা,তিনটি কিস দিতে হবে।মায়াবী তাই করল।
তারপর মায়াবী বলল,ভালোবাসবো,শুভেচ্ছা জানাব আবার চুমুও দিব তাহলে আপনি কি করবেন,জনাব?
ফাহিম বলল,আমি আর কি করব!আমি তো আমাকেই দিয়ে রেখেছি আপনার কাছে,জনাবা।
মায়াবী বলল,হুম!বুঝলাম।
মায়াবী বুঝলাম বলল ঠিকই,কিন্তু ফাহিমকে কেন যেন পুরোপুরি আজকাল বিশ্বাস করতে পারেনা,ও মায়াবীর সাথে একই রকমের ব্যাবহার করছে তবুও মায়াবী ফাহিমকে বিশ্বাস করতে পারছেনা।সন্দেহবান হওয়া মানুষের জন্য খুবই খারাপ।সন্ধেহ মানুষকে শেষ করে দেয়।
ফাহিম বলল,তুমি কালকে বেনুদের বাসায় থেকো,আমি ওখান থেকে তোমাকে পিকআপ করব।আজকে রাখি,অনেক অনেক ভালোবাসা আর আদর রইলো তোমার জন্য।গুড নাইট।
মায়াবী বলল,সেম টু ইউ।গুড নাইট।
পরের দিন মায়াবী ফাহিমের পছন্দের সাঁজ দিয়ে বেনুদের বাসায় গেল।বেনুর সাথে আগেই কথা হয়েছে।ফাহিম বেনুদের বাসায় আসতে দেরি করল।মায়াবী বাইকে উঠতে উঠতে প্রশ্ন করলো,এত দেরি হোল কেন?
ফাহিম বলল,একটা কাজ ছিল।একজনের সাথে দেখা করতে গিয়েছিলাম।
মায়াবী বলল,কার সাথে? কোথায়?
ফাহিম বলল,সব কিছুতে এত কিউরিসিটি দেখাও কেন?এত তো ভাল না!নিশ্চয়ই জরুরী কাজ ছিল,তাই গিয়েছি।তোমার সাথে তো আজকে সারাদিনই টাইম পাস করব,বলেছি।তবে এতো কিছু জেনে কি করবে?
মায়াবী আর কোন প্রশ্ন করলনা কারণ ফাহিম রেগে গেছে আর রাগাতে চায়না।তাই চুপ করে রইল।মনে মনে ভাবল,গত রাতে তো ফাহিম ঠিকই মজা করে কথা বলল কিন্তু আজকে আবার কি হোল!মায়াবী বুঝতে পারছেনা।ওরা‘মিড নাইট সান’ রেস্টুরেন্টে গিয়ে বসলো কারণ দুপুর হয়ে গিয়েছিল।খাওয়া দাওয়া করে ওরা বসুন্ধরা সিনেপ্লেক্স এ মুভি দেখতে যাবে তিনটা থেকে নয়টার সো।এখন বাজে বারটা।
মায়াবী কোন কথা বলছেনা দেখে ফাহিম বলল,কি হোল একদম চুপ মেরে গেলে!
মায়াবী বলল,কি বলবো!যা জানতে চাই তাতেই তুমি রাগ কর,তাই।
ফাহিম বলল,রাগের কথা বললে তো রাগ করবই।তোমার কি খবর?কবে আবার ব্লাড দিতে হবে?
মায়াবী বলল,রক্তের ব্যবস্থা হলেই,আবার যাব।আমার গ্রুপের রক্ত তো পাওয়া যায় না।আমারও আর ভালো লাগছেনা!এভাবে বেঁচে থাকার কোন মানে নেই।তার চেয়ে তাড়াতাড়ি চলে যাওয়া বেটার।তোমার হাতটি দেখি।
ফাহিম বলল,হাত দেখতেও পারো!
মায়াবী বলল,আমি হাত দেখতে পারি কে বলেছে?তোমার জন্য একটি ঘড়ি কিনে এনেছি আমার পছন্দের,তাই তোমাকে পড়িয়ে দেবো।
ফাহিম বলল,ওহ!তাই বলো,আমি ভাবলাম আবার জ্যোতিষী হয়ে গেলে নাকি!এই বলে হাতটি বাড়িয়ে হাসতে লাগল।
মায়াবী ফাহিমের হাতের দিকে তাকিয়ে চমকে গেল!ফাহিমের হাতে নতুন সোনার ব্রেসলেট!এতক্ষণ দেখেনি কারণ ফাহিম ফুলহাতা সার্ট পড়ে ছিল টি সার্টের ওপর। ফাহিমকে মায়াবি বলল,কি ব্যাপার!তুমি তো কখনো হাতে ব্রেসলেট পরোনা,তবে আজকে আমি কি দেখছি।কে দিল?
ফাহিম ভণিতা করে বলল,দিয়েছে একজন।তুমি কি দিবে দাও।
মায়াবির সেদিন গ্রুপিংএ জেরিন কেয়াকে বলেছিল ওর পছন্দের মানুষকে ব্রেসলেট কিনে দিবে।ফাহিমকে জেরিন দেয়নি তো!এখন তো ফাহিমকে কিছু বলাও যাবেনা তাই বলল,হুম!কখনো তো পড়নি!তাই জানতে ইচ্ছে হল,এই বলে ফাহিমের হাতে ঘড়িটা পড়িয়ে দিল।
ফাহিম বলল,কখন পড়িনি তাই বলে কি এখন পড়া যাবেনা,এমন তো কথা নেই। মানুষের রুচির পরিবর্তন হতেই পারে!এ আর এমন কি?
যেহেতু মায়াবী প্রতি নিয়ত ফাহিমকে সন্দেহ করে,ফাহিম ওকে এত ভালোবাসা সত্ত্বেও তাই ফাহিম ইচ্ছে করেই বলেনি কে দিয়েছে ব্রেসলেটটি।কারণ ফাহিমের ভালো লাগেনা মায়াবীর এই সন্দেহ প্রবণতা।
ওয়েটার স্যুপ দিয়ে গেলে মায়াবী ফাহিমকে স্যুপ বেড়ে দিয়ে নিজের সুপের বাটিতে স্যুপ নিয়ে অনবরত গোলমরিচের গুড়ো ঢালতে লাগল সসের পরিবর্তে।না দেখে যখন খেতে গেল ওর খাবার মাথায় উঠে গেল!ওর কাশতে কাশতে বমি হবার যোগার। ফাহিম তাড়াতাড়ি পানি দিল আর বলল,এটা খাওয়া লাগবেনা রেখে দাও।মায়াবি রেখে দিল।তারপর বাকি খাবার খেয়ে ওরা দুজন মুভি দেখে বাড়ি ফিরল।ফাহিম মুভি চলার সময় সারাক্ষণ ওর কাঁধে হাত রেখে বসেছিল।মাঝে মাঝে ওর হাতে চুমু দিচ্ছিল কিন্তু মায়াবীর কোন কিছুই ভালো লাগছিলনা।সারাক্ষণ ব্রেসলেটের কথা মনে হচ্ছিল।
ফাহিমের মায়াবীর চেহারা দেখে ভালো মনে হচ্ছিলনা তাই বলল,তোমার কি খুব খারাপ লাগছে?আমি কি কিছুক্ষণ তোমার সাথে থাকবো?
মায়াবী বলল,না,তুমি ভাবীর সাথে দেখা করে যাও।ভাইয়াও মনে হয় বাসাতেই আছে।
ফাহিম তো আর জেরিনের কথা জানেনা,ও কি বলেছিল তাই মায়াবীর হঠাৎ করে খারাপ লাগার কারণটা বুঝতে পারছেনা।ফাহিম ওর বোনের কাছে গিয়ে বলল,মায়াবী অসুস্থ হয়ে পড়ছে ওকে ডাক্তার দেখানো দরকার।ভাইয়া,শুনে বলল,চল দেখি গিয়ে,কি হয়েছে।
মায়াবী ওর রুমে ঢুকে বাথরুমে গিয়ে খুব কাশছিল তার ফলে ওর নাক মুখ দিয়ে আবার রক্ত পড়া শুরু হল,ও যতই কাশছে নাকে মুখে ততই রক্ত ঝরছে।মা,বাবা,ভাইয়া ভাবি ও ফাহিম সবাই চলে আসলো ওর রুমে।মায়াবীর এই অবস্থা দেখে ওর মা কান্নাকাটি শুরু করল।
মায়াবী আজকে বুঝতে পারলো যখনি ও বেশি চিন্তা করে তখনি এই নাক মুখ দিয়ে রক্ত ঝরতে থাকে।ফাহিমের এই ব্রেসলেট ওকে অনেক ভাবিয়ে তুলেছে।মায়াবি জানে ও বেশিদিন নেই!তবুও ওর বেঁচে থাকা অবস্থায় ফাহিম অন্য কারো হবে তা ও মেনে নিতে পারবে না।কারণ ওর প্রতিটি নিঃশ্বাসে ফাহিম।ফাহিমের প্রতি ওর অঘাত বিশ্বাস,এই বিশ্বাস যেন অবিশ্বাস হয়ে ওর সারা শরীরের রক্তে বিষ হয়ে যেন না মিশে যায়,এই দোয়াই করে।মায়াবী কাউকে কিছুই বলল না।এমন কি ফাহিমকেও না।ও খুঁজে বের করবে ফাহিম কার কাছ থেকে পেয়েছে,ঐ ব্রেসলেট।
ফাহিম ওর বাবা ডাক্তার ফয়েজকে কল দিয়ে বলল,বাবা,তুমি তাড়াতাড়ি আপুদের বাসায় চলে আসো,মায়াবীর অবস্থা খারাপ।
ফাহিমের বাবা এ্যাম্বুলেন্স ডাকতে বলল,মায়াবিকে এখুনি হাসপাতালে নিতে হবে।
রাতেই মায়াবীকে হাসপাতালে ভর্তি করা হোল।ফাহিম মায়াবীর পরিবারের সবার সাথে হাসপাতালে ছিল।মায়াবির রক্ত লাগবে সারা রাত ওরা রক্তের জন্য সবাইকে বলল। এমনকি ফেসবুকেও স্ট্যাটাস দিল,কারণ মায়াবির রক্তের গ্রুপ ওনেগেটিভ এই রক্ত সহজে পাওয়া যায় না।কোনো রকমে এক ব্যাগ রক্ত যোগার হোল,তাই পুশ করানো হোল মায়াবীকে।তারপরেও মায়াবীর তেমন কোন উন্নতি হলোনা।পরেরদিন আরও রক্তের প্রয়োজন।অনেকেই রক্ত দেয়ার জন্য এগিয়ে এল কিন্তু যাদের রক্তর গ্রুপ ওনেগেটিভ তাদের রক্তের সাথে মায়াবীর রক্তের ক্রোশ ম্যাচিং হচ্ছেনা।মায়াবীর জন্য সকলে মিলে শেষ চেষ্টা করে গেল কিন্তু শেষ রাতের দিকে মায়াবীর অবস্থা খারাপ হতে লাগল,নাক মুখ দিয়ে রক্ত ঝরার সাথে সাথে ইন্টারনেল ব্লিডিং শুরু হয়ে গেল ফলে ওর বাঁচার আশা ক্ষীণ থেকে ক্ষীণতর হতে লাগল।সেদিন ভোরের দিকে সবার মায়া মমতা,ভালোবাসা আর ফাহিমের জন্য ওর নিঃশ্বাসে যে প্রেম লালন করত তা ছেড়ে দিয়ে,সময়ের আগেই না ফেরার দেশে চলে গেল।সব কিছু পেছনে ফেলে দিয়ে ফাহিমের বিশ্বাসের বিষ ওর রক্তের সাথে মিসে গেল।ও জানতেও পারলনা!ফাহিমকে ঐ ব্রেসলেটটি দিয়েছিল,ফাহিমের মা।
“সমাপ্ত”