সেলিম আহমেদঃ চলতি মাসের শুরু থেকেই করোনা সংক্রমণে গতি বেড়েই চলেছে। এ যেন এক ‘পাগলা ঘোড়া’। কোনোভাবেই এর লাগাম টানা যাচ্ছে না। উল্টো গরমের আঁচ যতই বাড়ছে সংক্রমণ ও মৃত্যুর গ্রাফ ততই উপরে উঠছে। ২ শতাংশে নেমে আসা শনাক্তের হার এখন ২২ দশমিক ৯৪ শতাংশে ঠেকেছে। গত ৪ দিন থেকেই আগের দিনের রেকর্ড ভেঙে তৈরি হচ্ছে নতুন রেকর্ড।
সর্বশেষ বৃহস্পতিবার করোনায় সংক্রমিত হয়েছেন ৬ হাজার ৪৬৯ জন- যা করোনাকালের সর্বোচ্চ রেকর্ড। আর এই দিনে করোনায় আক্রান্ত হয়ে মৃত্যু হয়েছে ৫৯ জনের-যা দেশে একদিনে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ মৃত্যু। এর আগে গেল বছরের ৩০ জুনে ৬৪ জন মারা গিয়েছিলেন। ধারণার বাইরে অপ্রতিরোধ্য গতিতে সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ায় উদ্বিগ্ন স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা।
এদিকে ফের করোনার সংক্রমণ বাড়তে থাকায় দেশের সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালগুলোতে বাড়ছে রোগীর চাপ। সেই চাপ সামাল দিতে হিমশিম খেতে হচ্ছে চিকিৎসকদের। গত বুধবার বিকালে ঢাকার হাসপাতাল ও আইসিইউতে রোগী ভর্তির জায়গা নেই বলে সাফ জানিয়ে দিয়েছেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী ডা. জাহিদ মালেক।
তিনি বলেন, গত ২০ দিন থেকে করোনা সংক্রমণ নাটকীয়ভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে যা অশনিসংকেত। যে হারে সংক্রমণ এবং রোগী বাড়ছে সারা শহরকে হাসপাতাল বানালেও রোগীর জায়গা হবে না। এমন পরিস্থিতিতে আগামী ১৫-২০ দিনের মধ্যে আরো কিছু বেড ও আইসিইউ বাড়ানো হবে।
পাশাপাশি করোনা সংকট মোকাবিলায় বেসরকারি হাসপাতালগুলোকে এগিয়ে আসার আহ্বান জানিয়েছেন তিনি। পরিস্থিতির আরো অবনতি হলে সরকারি হাসপাতালগুলোর সাধারণ চিকিৎসা বন্ধ করে শুধু করোনার চিকিৎসা দেয়া হবে বলেও চিন্তা রয়েছে সরকারের।
এ প্রসঙ্গে শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক খলিলুর রহমান বলেন, ‘রোগীর খুবই চাপ, এমন একটা অবস্থা যে, আমরা রোগীদের ঠাঁই দিতে পারছি না। নতুন রোগীদের অধিকাংশেরই অক্সিজেনের প্রয়োজন হচ্ছে। তাই আমরা অক্সিজেনের রোগী ছাড়া ভর্তি নিচ্ছি না। সংক্রমণ এভাবে বাড়তে থাকলে সরকারের নির্দেশনা অনুযায়ী সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে নন-কোভিড রোগের চিকিৎসা পুরোপুরি বন্ধ করে দিয়ে কোভিডের চিকিৎসা চালানো হবে।’
অন্যদিকে এখন যারা সংক্রমিত হচ্ছেন তাদের সঙ্গে সঙ্গেই শারীরিক পরিস্থিতির অবনতি হচ্ছে। তরুণ থেকে বায়োবৃদ্ধ সব বয়সী মানুষের মধ্যে অধিকাংশেরই তীব্র শাসকষ্টজনিত সমস্যা দেখা দিচ্ছে। ফলে দ্রুত তাদের আইসিইউতে নিতে হচ্ছে কিংবা হাইফ্লো অক্সিজেন দিতে হচ্ছে। তবে হাসপাতালে সিট খালি না থাকায় তারা চিকিৎসার জন্য ঘুরছেন হাসপাতাল থেকে হাসপাতালে। সরকারি হাসপাতালে ভর্তি হতে না পেরে অনেকেই বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি হয়ে চিকিৎসা নিচ্ছেন। বেসরকারি হাসপাতালেও শয্যা পাওয়া এখন কঠিন হয়ে যাচ্ছে।
স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা ধারণা করছেন, সম্প্রতি দেশে নতুন ধরনের করোনা (যুক্তরাজ্য ও আফ্রিকায় শনাক্ত হওয়া নতুন করোনা) ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়েছে। ফলে উপসর্গ না থাকলেও অস্বাভাবিকভাবে রোগী বাড়ছে। গরমের প্রকোপে এ পরিস্থিতির আরো অবনতি হলে পারে বলে ধারণা তাদের।
রোগীর চাপ প্রসঙ্গে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক কর্নেল নাজমুল হক বলেন, ‘বিশাল চাপ এখন করোনা রোগীদের। কোনো বেড আমাদের ফাঁকা নেই। জেনারেল যারা মেডিসিনের কেস নিয়ে আসছেন, তাদের নিতে পারছি না আমরা। ক্ষমতার চেয়েও বেশি রোগী নিয়ে আছি আমরা।’
আগের তুলনায় ৫০ থেকে ৬০ শতাংশ বেশি ‘ক্রিটিক্যাল’ রোগী এখন চিকিৎসার জন্য আসছে জানিয়ে তিনি বলেন, বয়স্করা হয়ত বাসায় থেকে চিকিৎসা নিচ্ছিল। কিন্তু অক্সিজেন স্যাচুরেশন কমে যাওয়ায় তারাও ক্রিটিক্যাল রোগী হিসেবে আসছেন। এভাবে যদি চলতে থাকে, আমরা যদি লাগাম টেনে ধরতে না পারি, এটা কিন্তু দুই-তিন সপ্তাহ পরে দ্বিগুণ হয়ে যাবে। মানুষের দুর্দশাও বাড়বে। একটা কঠিন সময় আসছে আমাদের জন্য।’
বাংলাদেশ বেসরকারি মেডিক্যাল অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি এমএ মুবিন খান বলেন, ‘করোনার নতুন ধরন একটু ভিন্ন। আক্রান্ত ব্যক্তি হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়েন। নতুন ধরনে কারো ক্ষেত্রে ফুসফুস, আবার করো গ্যাস্ট্রো-এন্টারোলজিক্যাল সিস্টেমগুলো মারাত্মকভাবে সংক্রমিত হয়। তখন দ্রæততম সময়ে চিকিৎসার আওতায় নেয়া প্রয়োজন হয়। এখন যারা আক্রান্ত হচ্ছেন, তাদের অধিকাংশকেই আইসিইউতে নিতে হচ্ছে। এই কারণে এখনই পদক্ষেপ নেয়া উচিত। এ জন্য সরকারি পাশাপাশি বেসরকারি হাসপাতালগুলোতে আইসিইউ বেড বাড়ানোর প্রয়োজন।
বেসরকারি হাসপাতাল এভারকেয়ার হাসপাতালের জ্যেষ্ঠ মহাব্যবস্থাপক ডা. আরিফ মাহমুদ বলেন, কয়েক সপ্তাহ আগে হাসপাতালের কোভিড ইউনিট প্রায় ফাঁকা ছিল। ১৯ মার্চের পর থেকে রোগীর চাপ আবার বেড়ে গেছে।
ইউনাইটেড হাসপাতালের কমিউনিটেকশন অ্যান্ড বিজনেস ডেভেলপমেন্টের প্রধান ডা. সেগুফা আনোয়ার বলেন, কোনো সিট নেই। আপনি যদি সিট চান, আমি দিতে পারব না। আমি এখন কারো ফোন ধরতে ভয় পাই। কারণ ‘না’ বলতে হবে। খুব কষ্টের ব্যাপার।
রেকর্ড ভেঙে একদিনে শনাক্ত ছাড়াল ৬ হাজার, মৃত্যু ৫৯: দেশে গত ২৪ ঘণ্টায় নতুন করে করোনা শনাক্ত হয়েছেন ছয় হাজার ৪৬৯ জন। এটি দেশের ইতিহাসে এখন পর্যন্ত একদিনে সর্বোচ্চ শনাক্ত। দেশে এই প্রথম ৬ হাজারের বেশি রোগী শনাক্ত হলেন। নতুন শনাক্ত হওয়াদের নিয়ে দেশে এ পর্যন্ত সরকারি হিসাবে শনাক্ত হয়েছেন ছয় লাখ ১৭ হাজার ৭৬৪ জন। গত একদিনে মারা গেছেন ৫৯ জন। এ নিয়ে এখন পর্যন্ত মারা গেলেন ৯ হাজার ১০৫ জন। এই সময়ে করোনা থেকে সুস্থ হয়েছেন দুই হাজার ৫৩৯ জন, তাঁদের নিয়ে দেশে করোনা থেকে এখন পর্যন্ত সুস্থ হলেন পাঁচ লাখ ৪৪ হাজার ৯৩৮ জন।
এর আগে গত ২৯ মার্চ করোনাকালের সর্বোচ্চ শনাক্তের রেকর্ড হয় বাংলাদেশে। সেদিন একদিনে শনাক্ত হন পাঁচ হাজার ১৮১ জন। ৩০ মার্চ শনাক্ত হন পাঁচ হাজার ৪২ জন। গত তিন দিন ধরে একদিনে শনাক্ত হওয়া রোগীর সংখ্যা ছিল পাঁচ হাজারের ওপরে। গতকাল শনাক্ত হন পাঁচ হাজার ৩৫৮ জন। করোনাকালে বাংলাদেশে এটাই ছিল একদিনে সর্বোচ্চ শনাক্ত। আজ সেই রেকর্ডও ভেঙে গেল। গত ২৪ ঘণ্টায় রোগী শনাক্তের হার ২২ দশমিক ৯৪ শতাংশ, এখন পর্যন্ত শনাক্তের হার ১৩ দশমিক ১৫ শতাংশ। শনাক্ত বিবেচনায় সুস্থতার ৮৮ দশমিক ২১ শতাংশ এবং শনাক্ত বিবেচনায় মৃত্যুহার এক দশমিক ৪৭ শতাংশ।