আইরিশ বাংলাপোস্ট ডেস্কঃ পূর্ব ইউরোপের দেশ বেলারুশের ২৬ বছরের শাসক অ্যালেক্সান্ডার লুকাশেংকোর পদত্যাগের দাবিতে জনগণ আন্দোলন করছে বিগত দুই মাস থেকে। ইতিমধ্যে গত সোমবার ইউরোপীয় ইউনিয়ন লুকাশেঙ্কোর বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করতে সম্মত হয়েছে। বিগত আগস্ট মাসে নির্বাচনের পর ব্যাপক কারপচুপির অভিযোগ এনে বিরোধী দল ফলাফল প্রত্যাখ্যান করে, সারাদেশে বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে। বিরোধী নেতৃ তিখানোভস্কিয়া গ্রেপ্তার এড়াতে লিথুয়ানিয়ায় রাজনৈতিক আশ্রয় নিয়ে সেখান থেকেই আন্দোলনের নেতৃত্ব দিচ্ছেন। আন্দোলন নিয়ন্ত্রণে সরকারী বাহিনী ব্যাপক ধরপাকড়, নিপীড়ন আর অত্যাচার করছে বলে অভিযোগ উত্থাপিত হয়েছে।
লিথুয়ানিয়া থেকে গতকাল মঙ্গলবার এক বিবৃতিতে তিখানাভোস্কি বলেন, রাজনৈতিক সংকট, সহিংসতা আর অনাচার অনেক হয়েছে। প্রতিবাদকারীদের বিরুদ্ধে প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যাবহারের অনুমতি দেয়ার পরদিনই তিনি ঘোষণা করেন, “প্রতিবাদকারীদের বিরুদ্ধে সহিংসতা বন্ধ করতে হবে, রাজনৈতিক বন্দীদের মুক্তি দিতে হবে আর পদত্যাগ করতে হবে। এই দাবীগুলো আগামী ২৫শে অক্টোবরের মধ্যে মানা না হলে ২৬শে অক্টোবর থেকে দেশ্যব্যাপি বিশাল আন্দোলন ও ধর্মঘট শুরু হবে, সমস্ত পথঘাট বন্ধ করে দেয়া হবে, রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন কোন দোকানপাট খুলবেনা।” বিরোধীরা এই দাবিকে “জনগণের আলটিমেটাম” হিসাবে অভিহিত করছে।
বেলারুশের স্বৈরশাসক আলেকজান্ডার লুকাশেংকো গতকাল কারাগারে রাজনৈতিক বন্দীদের সাথে দেখা করতে এসেছিলেন। এই কারাগারেই বন্দী অবস্থায় আছেন মিসেস তিখানোভস্কয়ের স্বামী। আগস্টের নির্বাচনে মিঃ লুকাশেঙ্কোর বিরোধিতা করা থেকে বাধা দেওয়ার উদ্দেশ্যে তাকে বন্দী করা হলে স্কুল শিক্ষিকা স্ত্রী তিখানোভোস্কি স্বামীর জায়গা থেকে প্রতিদ্বন্দীতা করেন।নির্বাচন পরবর্তী সময়ে বিশাল কারচুপির অভিযোগে শক্তিশালী আন্দোলন গড়ে তুলেন স্কুল শিক্ষয়িত্রী বন্দী রাজনৈতিক নেতার স্ত্রী।
লুকাশেংকোর বিরুদ্ধে মিসেস তিখানোভোস্কি হুশিয়ারি উচ্চারণ করে বলেন, “আমরা বেশ কয়েকবার সংলাপ ও আলোচনার কথা বলেছি। কারাগারের অভ্যন্তরে আলোচনা করা কোনও সংলাপ নয়।” তিনি জনগণের উদ্দেশ্যে বলেন “যে সকল ব্যক্তি এখনও জনগণের পক্ষে আসার সিদ্ধান্ত নেননি তারা সন্ত্রাসের আনুষঙ্গিক। জনসমক্ষে ঘোষণা করুন যে আপনি আর এই সরকারকে সমর্থন করেন না।”
আন্দোলন দমনে সরকার যে দমন নিপীড়ন করছে সেটা মোটামুটি নিশ্চিত। সোমবার স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় নিশ্চিত করেছে যে রাজধানী মিনস্কে একটি অননুমোদিত সমাবেশে পুলিশ স্ট্রেন গ্রেনেড এবং টিয়ারগ্যাস নিক্ষেপ করেছে, এতে প্রচুর বয়স্ক বিক্ষোভকারীরা সংযুক্ত ছিলেন। একজন মুখপাত্র বলেছেন, “নাগরিকরা আগ্রাসন দেখাতে শুরু করার পরে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছিল। অপ্রকাশিত সংখ্যক বিক্ষোভকারীকে গ্রেপ্তারও করা হয়েছিল। রাশিয়ার বার্তা সংস্থা তাসের তথ্য অনুসারে সোমবার ১৮৬ জনেরও বেশি আন্দোলনকারীকে আটক করা হয়েছিল।
বেলারুশ প্রেসিডেন্ট শাসিত একটি প্রজাতন্ত্র। প্রেসিডেন্ট এবং জাতীয় সংসদ দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। নির্বাচিত প্রেসিডেন্টের মেয়াদ ছিল পাঁচ বছর। ১৯৯৬ সালে প্রথম একটি বিতর্কিত রেফারেন্ডামের মাধ্যমে পাঁচ বছরের মেয়াদ বাড়িয়ে সাত বছর করা হয়, যার ফলশ্রুতিতে ১৯৯৯ সালের নির্ধারিত প্রেসিডেন্ট নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় ২০০১ সালে। ১৯৯৪ সালের সংবিধানে প্রেসিডেন্ট হিসাবে মাত্র দুই মেয়াদে দায়িত্ব পালন করার সুযোগ ছিল তাই ২০০৪ সালে লুকাশেংকো পুনরায় রেফারেন্ডাম আয়োজন করে সংবিধান পরিবর্তন করে এই মেয়াদ অনির্দিষ্টকাল পর্য্যন্ত বর্ধিত করেন, তবে সাত বছরের বদলে পুনরায় পাঁচ বছরে ফিরে যান। আলেকজান্ডার লুকাশেঙ্কো ১৯৯৪ সাল থেকে বেলারুশের রাষ্ট্রপতি হিসেবে নির্বাচিত হয়ে আসছেন।
২০০৬ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে লুকাশেঙ্কোর বিরোধী জোটের প্রতিনিধিত্বকারী আলাকসান্দার মিলিঙ্কিভিয় এবং সোশ্যাল ডেমোক্র্যাটস-এর আলাকসান্দার কাজুলিন নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বী হয়েছিলেন। অল বেলারুশিয়ান পিপলস অ্যাসেমব্লিকে ঘিরে বিক্ষোভ চলাকালে কাজুলিনকে পুলিশ আটক ও মারধর করেছিল। লুকাশেঙ্কো ২০০৬ সালে ৮০ শতাংশ ভোট পেয়ে বিজয়ী হলে; রাশিয়ান ফেডারেশন এবং সিআইএস ভোটকে উন্মুক্ত ও সুষ্ঠু বলে মনে করেছে, কিন্তু ও এস সিই এবং অন্যান্য সংগঠনগুলি নির্বাচনটিকে অন্যায্য বলে অভিহিত করেছে।
২০১০ সালের ডিসেম্বরের নির্বাচন, লুকাশেঙ্কো নির্বাচনে আবারো ৮০ শতাংশ ভোট পেয়ে চতুর্থ মেয়াদে নির্বাচিত হয়েছিলেন। রানার-আপ বিরোধী নেতা আন্দ্রেই সানিকোভ পেয়েছিলেন ৩ শতাংশেরও কম ভোট। স্বাধীন পর্যবেক্ষকরা ঐ নির্বাচনকে প্রতারণামূলক বলে সমালোচনা করেছিলেন। বিরোধী প্রতিবাদকারীরা যখন মিনস্কে রাস্তায় আন্দোলনে নেমেছিল, তখন বেশিরভাগ প্রতিদ্বন্দ্বী রাষ্ট্রপতি প্রার্থী সহ অনেক লোককে রাষ্ট্রীয় মিলিশিয়ারা মারধর করে এবং গ্রেপ্তার করে। সানিকভ সহ অনেক প্রার্থীকে কারাগারে বা গৃহবন্দি করা হয়েছিলো যার মধ্যে অনেকেই চার বছর পর্য্যন্ত কারারুদ্ধ ছিলেন।
এবারে ২০২০ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে আবারও লুকাশেঙ্কোর পক্ষে সরকারী ফলাফল ছিল ৮০ শতাংশ। নির্বাচন প্রক্রিয়া এবং তারপরের ঘটনাগুলি নিয়ে বিশ্বের অনেক পর্য্যবেক্ষক ও সম্প্রদায় উদ্বিগ্ন। ডেমোক্রেসি ইনডেক্স রেটিং অনুসারে বেলারুশ ইউরোপের সর্বনিম্ন অবস্থানে আছে, এদিকে “ফ্রিডম হাউস” থেকে দেশটিকে “মুক্ত নয়” হিসাবে চিহ্নিত করা হয়েছে, অর্থনৈতিক স্বাধীনতার সূচকে “নিপীড়িত” হিসাবে এবং ২০১৩-১৪ সালে ইউরোপের প্রেস স্বাধীনতার জন্য সবচেয়ে খারাপ দেশ হিসাবে চিহ্নিত করেছে– রিপোর্টার্স উইথ বর্ডারস।