সিরাজাম মুনিরাঃ জীবনের প্রতিটি ধাপে প্রয়োজন আলাদা পুষ্টি উপাদান। কোনো ধাপে নির্দিষ্ট পুষ্টির ঘাটতি থেকে গেলে পরবর্তী ধাপে মানুষ বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হয়, শারীরিকভাবে দুর্বলতা বোধ করে।
শিশুকাল, কৈশোর, যৌবন ও বৃদ্ধ—এই চার স্তরে মানুষের খাবারের চাহিদা এক রকম নয়। সঠিক বয়সে, সঠিক পরিমাণে সুষম খাবার খেলে রোগ প্রতিরোধ সহজ হবে এবং কর্মক্ষম থাকা যাবে দীর্ঘদিন।
শিশুদের খাবার
জন্মের পর থেকে ছয় মাস পর্যন্ত শুধু মায়ের বুকের দুধ শিশুর জন্য প্রয়োজনীয় পুষ্টি উপাদান সরবরাহ করে। এরপর থেকে শিশুদের পুষ্টির চাহিদা বাড়তে থাকে বলে বাড়তি খাবার প্রয়োজন হয়। তা না হলে শিশুর শারীরিক ও মানসিক বৃদ্ধি ঠিকমতো হবে না। ছয় মাস পর থেকে শিশুর আয়রন ও ভিটামিন সি-যুক্ত খাবারের প্রয়োজনীয়তা বেড়ে যায়। এগুলো মায়ের দুধ পূরণ করতে পারে না। এই বাড়তি চাহিদা পূরণের জন্য প্রয়োজন বাড়তি খাবার।
১ থেকে ৫ বছর
এ সময় শিশুরা সাধারণত চঞ্চল হয়, তারা হাঁটতে শেখে, খেলাধুলা ও ছোটাছুটিতে ব্যস্ত থাকে। এসব কারণে শিশুরা এক জায়গায় স্থির হয়ে বসে খেতে চায় না। ফলে প্রয়োজনীয় পুষ্টি উপাদানে ঘাটতি দেখা দেয়। শিশুদের দেহ গঠনের জন্য প্রোটিনের চাহিদা বেড়ে যায়। এ সময় তাদের আঁশজাতীয় খাবার না দেওয়াই ভালো। এ বয়সে যারা দুধ খেতে পছন্দ করে না, তাদের সরাসরি দুধ না দিয়ে দুধের তৈরি খাবার দেওয়া যেতে পারে। আবার অনেক শিশু দুধ ও দুধের তৈরি খাবার পছন্দ করে বলে অন্য খাবার খেতে চায় না। এ ক্ষেত্রে দুধ ও দুধের তৈরি খাবারের পরিমাণ কমিয়ে প্রোটিনযুক্ত অন্যান্য খাবার, যেমন মাছ, মুরগি, কলিজা, গরু অথবা খাসির মাংস ইত্যাদি দিতে হবে। এই বয়সে প্রোটিন, ভিটামিন সি, এ শিশুদের জন্য খুবই দরকার।
সাধারণত ৫ বছরের পর স্কুলে ভর্তি হলে শিশুদের নতুন করে খাবারের প্রতি অনীহা বাড়ে। খাবার পছন্দ-অপছন্দের বিষয়টি তাদের বেশ জোরালোভাবে দেখা দেয়। বাইরের খাবারের প্রতি আগ্রহ তৈরি হয়। তবে বাইরের খাবার খুব বেশি খেলে ওজন বেড়ে যাওয়া, পুষ্টির অভাব, ঘরে তৈরি খাবারে অনীহা, কৃমির প্রকোপ ইত্যাদি দেখা দিতে পারে।
১২ থেকে ১৮ বছর
এ বয়সে ক্যালরি ও প্রোটিনের চাহিদা অনেক বেড়ে যায়। এ সময় ক্ষুধা ও শর্করাবহুল খাবারের প্রতি ঝোঁক বাড়ে। প্রোটিন তেমন খেতে চায় না কেউ। ফলে শরীর দুর্বল হয়ে যায়। এ সময় হাড় ও মাংসপেশি বর্ধনের জন্য ক্যালসিয়াম ও আয়রন প্রয়োজন। ছেলেদের তুলনায় মেয়েদের এ সময় আয়রনসমৃদ্ধ খাবারের প্রয়োজন বেড়ে যায়। এ জন্য তাদের খাবারে থাকতে হবে ডিম, কলিজা, মাংস, সব রকমের সবজি ও শাক। প্রতিদিন ডাল ও টক ফল খেতে পারলে ভালো হয়। এ সময় বিপাকক্রিয়ার গতি বেড়ে যায়, ফলে আয়োডিনযুক্ত খাবার খেতে হয়। এদিকে মেয়েদের তুলনায় ছেলেদের ভিটামিন বি বেশি প্রয়োজন তাদের শক্তি ও বর্ধনের জন্য।
১৮ থেকে ৬০ বছর
এ বয়সে মানুষ বেশ মানসিক চাপের মধ্যে থাকে। কর্মজীবনে প্রবেশ ও ক্যারিয়ার নিয়ে ব্যস্ত থাকার ফলে শরীরের প্রতি যত্নে অবহেলা হয় ব্যাপক। ফলে বিভিন্ন ধরনের অসুস্থতায় ভুগে থাকেন কেউ কেউ। বয়স যত বাড়বে, ক্যালরির পরিমাণ ততই কমিয়ে আনতে হবে। এ সময় সহজ শর্করা, অর্থাৎ চিনি-গুড় ইত্যাদি কমিয়ে ফেলা বা একেবারে বাদ দেওয়া ভালো। জটিল শর্করা, যেমন ভুসিযুক্ত আটার রুটি, লাল চাল, ডাল ও আঁশযুক্ত খাবার খাওয়া ভালো। এতে ওজন বৃদ্ধি ও কোষ্ঠকাঠিন্য থেকে বাঁচা যাবে।
মোট ক্যালরির ১০ থেকে ১৫ শতাংশ চর্বিজাতীয় খাবার খেতে হবে। সাধারণত ৫০ বছরের পর মানুষের কোলেস্টেরল বেশি হতে দেখা যায়। সে জন্য উচ্চ কোলেস্টেরলযুক্ত খাবার, যেমন ডিমের কুসুম, কলিজা, মগজ, মাছের ডিম, চর্বিযুক্ত দুধ, হাঁস-মুরগির চামড়া ছাড়া মাংস খেতে হবে।
এ ছাড়া মোট ক্যালরির ১৫ থেকে ২০ শতাংশ প্রোটিন বা আমিষ খেতে হবে। এ সময় নতুন কোষ গঠন না হলেও শুধু কোষের রক্ষণাবেক্ষণের জন্যই প্রোটিন প্রয়োজন। হাড়ের ক্ষয় রোধ করার জন্য ভিটামিন ডি প্রয়োজন। এটি ক্যালসিয়াম শোষণে কাজে লাগে। খনিজ লবণের মধ্যে ক্যালসিয়াম ও আয়রনের প্রতি জোর দিতে হবে।
কোষ্ঠকাঠিন্য ও প্রস্রাবের সংক্রমণ এড়াতে পর্যাপ্ত পানি খেতে হবে। এতে ত্বকও ভালো থাকবে, শরীরে বয়সের ছাপ কম পড়ে। অসুখ-বিসুখ কম হবে।
৬০ বছর পর মানুষের খাওয়ার প্রতি আগ্রহ কমে যায়। এ সময় যেকোনো খাবার হজম করাও কষ্টকর হয়ে পড়ে। তাই এ বয়সে পরিমাণ কমিয়ে দিয়ে খেতে হবে কম মসলাযুক্ত ও সহজপাচ্য খাবার। দাঁতের সমস্যার জন্য যাদের খাবার খেতে অসুবিধা হয়, তাঁদের নরম ও তরল খাবার খেতে হবে।
ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ, কিডনি ও লিভার কিংবা হার্টের অসুখ ইত্যাদি থাকলে খাদ্য নির্বাচনের আগে পুষ্টিবিদের পরামর্শ নেওয়া জরুরি।
পরামর্শ: কনসালট্যান্ট ডায়েটিশিয়ান, ইবনে সিনা মেডিকেল কলেজ, হাসপাতাল, ঢাকা