এ,কে, আজাদ- আইরিশ বাংলাপোষ্ট ডেস্কঃ ‘রমজান ঐ মাস; যে মাসে আমি কুরআন অবতীর্ণ করেছি’ (সুরা বাকারা)। পবিত্র মাহে রমজান দরজায় কড়া নাড়ছে। কেবল রমজানের চাঁদটি উদিত হওয়ার অপেক্ষায়। তারপর আল্লাহ তাআলার রহমতের দ্বার বান্দার জন্য উন্মুক্ত হয়ে যাবে।
পর্যায়ক্রমে রহমত-মাগফিরাত-নাজাতের মতো মহিমাময় উপহারসামগ্রী পরিবেশন করা হবে। শিকলে বাঁধা পড়বে অভিশপ্ত শয়তান। চারিদিকটা আল্লাহ তাআলার রহমতে বেষ্টিত হয়ে যাবে।
আত্মশুদ্ধির মাস মাহে রমজান। মহান আল্লাহর গুণে গুণান্বিত হওয়ার চেষ্টা করার সুবর্ণ সুযোগ এনে দেয় সেই মাহে রমজান। গুনাহ থেকে পুত-পবিত্র হওয়ার মাস মাহে রমজান। প্রতিটি মুসলমানের জীবনে তাই মাহে রমজানের গুরুত্ব ও তাৎপর্য অপরিসীম।
রহমত, মাগফিরাত ও নাজাত লাভের বাণী নিয়ে বিশ্বের মুসলমানদের দুয়ারে আবারও উপস্থিত হয়েছে পবিত্র রমজান। মাসব্যাপী সিয়াম সাধনার মধ্য দিয়ে মুসলমানরা এ তিন ধাপে ইবাদত-বন্দেগি করে আল্লাহর কাছে আত্মসমর্পণের প্রশান্তি লাভ করবে।
সারা বছর জ্ঞাত-অজ্ঞাতসারে তারা যে পাপ করেছে, তা থেকে ক্ষমা পাওয়ার মোক্ষম মাস হল এ রমজান। সিয়াম সাধনার দ্বারা আত্মশুদ্ধির মাধ্যমে তারা যে নাজাতের পথ খুঁজবে এতে কোনো সন্দেহ নেই। হাজার রজনীর শ্রেষ্ঠ রজনী লাইলাতুল কদর রমজান মাসকে করেছে বিশেষভাবে মহিমান্বিত।
এ রাতেই রাব্বুল আলামিন তার প্রিয় নবী হজরত মুহাম্মদের (সা.) ওপর সর্বশেষ ঐশী গ্রন্থ পবিত্র কোরআন নাজিল করেন। কোরআনের শিক্ষা হল বিশ্বাসী মানুষকে ইহলৌকিক ও পারলৌকিক জীবনে অশেষ কল্যাণ দান করা। কৃচ্ছ্রসাধন ও আত্মসংযমের এ মাসে তাই সংসারি মানুষ আল্লাহর প্রদর্শিত পথে চলার ওয়াদা করে, তাদের সবরকম গুনাহ্ মাফ করে দেয়ার আকুল প্রার্থনা জানায়। এ মাসে আল্লাহ তার বান্দাদের কঠোর ত্যাগ, ধৈর্য, উদারতা ও সততা প্রদর্শনের নির্দেশ দিয়েছেন।
শুধু উপবাস থাকাই রমজানের সাফল্য অর্জনের শর্ত নয়। বরং উপবাসের সাথে যাবতীয় পাপ কাজ যেমন—মিথ্যা কথা বলা, গীবত করা, চোগলখোরী করা. মুনাফাখোরী করা, কালোবাজারী, প্রতারণা ও প্রবঞ্চনার মতো ইসলাম বিরোধী কাজ থেকে বিরত না থাকলে রমজানের ফল পাওয়া যাবে বলে মনে করার কারণ নেই।
কারণ একদিকে দূর্নীতির মাধ্যমে সম্পদের পাহাড় গড়ে তোলা অন্যদিকে পবিত্র রমজান মাসে বড় বড় ইফতার মাহফিলের আয়োজন সমার্থক নয়। তাই রমজান মাসে মিথ্যা কথা বলা ত্যাগ করার অনুশীলন করতে হবে। এব্যাপারে যত্নবান হতে হবে নামাজের ব্যাপারে। কারণ নামাজ বেহেস্তের চাবি। রমজান উত্তর মাস গুলোতে নামাজেও শিথিলতা আসে। তাই রমজান মাসে জামায়াতে নামাজ আদায়ে মুসল্লিরা তৎপর হন। নামাজের জন্যে যেসব উপাদান রয়েছে, তা সঠিকভাবে পালন করতে হবে। যেমন কাপড় পচ্ছিন্ন থাকা। তবে কাপড় শুধু পরিস্কার হলে চলবে না, বরং সেই কাপড় হালাল অর্থে কেনা কিনা তাও স্মরণ রাখতে হবে। কেন না অবৈধ টাকায় কেনা পোষাকে নামাজ আদায় কতটুকু শুদ্ধ হবে, তাও খেয়াল রাখতে হবে। এবাদত সহি-শুদ্ধ হওয়ার জন্যে সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন হালাল রুজি-রোজগার। কেন না রুজি-রোজগার হালাল না হলে, যত এবাদাত-বন্দেগি করা হোক না কেন, তা কোনো কাজে আসবে না। তাই উপার্জন হালাল করতে হলে, ভাবতেই ঘুষ-দূর্নীতির সংস্পর্শ ত্যাগ করতে হবে। এই অভ্যাসের পরিবর্তন করার মাস হচ্ছে পবিত্র রমজান। ঘুষ-দূর্নীতি বর্জনের অনুশীলন সার্থক হলে, দেশের সব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে। দেশের উন্নতি, অগ্রগতি ও সমৃদ্ধি হবে দ্রুত। কারণ এক্ষেত্রে দূর্নীতি প্রধান বাধা।
পরিতাপের বিষয়, এ মাসেই একশ্রেণীর ব্যবসায়ী সততা আর ন্যায়নীতি ভুলে অতি মুনাফা লাভের প্রতিযোগিতায় নামে। তারা রমজান মাসকে মুনাফা লোটার প্রায় হাতিয়ার করে ফেলে। যথেচ্ছভাবে দ্রব্যমূল্য বাড়ানোর এই প্রবণতা আমাদের ব্যবসায়ীদের কৃচ্ছ্র আর আত্মশুদ্ধির বিপরীতে নিয়ে গেছে যেন।
রমজানে বিশেষ কিছু খাদ্যদ্রব্যের চাহিদা বেড়ে যায়। পাইকারি ব্যবসায়ী ও খুচরা দোকানিরা বাড়তি চাহিদাকে মুনাফা লোটার হাতিয়ার করে তোলে। অসৎ ব্যবসায়ীরা কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করেও দ্রব্যমূল্য বাড়িয়ে দেয়। রমজানের শিক্ষা অনুসরণের বদলে তারা যেন আরও সুযোগসন্ধানী ও বেপরোয়া হয়ে ওঠে।
রমজানে দ্রব্যমূল্য সহনীয় পর্যায়ে রাখতে বাজার মনিটরিং আরও জোরদার করা প্রয়োজন। সর্বসাধারণের কথা বিবেচনা করে সরকারকে এ সময়ে চাল-ডাল-চিনি-ভোজ্যতেল-ছোলা-বুটসহ প্রধান খাদ্যশস্যের দামের দিকে বিশেষভাবে দৃষ্টি রাখতে হবে।
রমজানে গ্যাস, বিদ্যুৎ ও পানি সংকট মানুষের দুর্ভোগের একটি বড় কারণ হয়ে দাঁড়ায়। নগরজীবনে অপরিহার্য উপকরণগুলোর সংকট কবে নিরসন হবে কে জানে! আমরা শুধু বলব, অন্তত রমজান মাসে যে কোনো উপায়ে পানি, বিদ্যুৎ ও গ্যাস সরবরাহ স্বাভাবিক পর্যায়ে রাখতে নেয়া হোক কার্যকর পদক্ষেপ। যানজট ও আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে পুলিশ প্রশাসনকে।
রমজানে একশ্রেণীর মানুষ সংযম ও কৃচ্ছ্রসাধনের পরিবর্তে ভোগ-বিলাসে মেতে ওঠে। সম্পদশালীদের ভেতর চলে ইফতার পার্টির প্রতিযোগিতা। ভোগ-বিলাস ও যথেচ্ছাচার ত্যাগ করে সহজ, সুন্দর ও অনাড়ম্বর জীবনাচারে অভ্যস্ত হওয়ার সুযোগ সৃষ্টি হয় পবিত্র রমজানে।
সরকারের পাশাপাশি সমাজের বিত্তবানদেরও দায়িত্ব রয়েছে গরিবদের পাশে দাঁড়ানোর। গরিব-দুঃখীদের বিপদে তাদের সহায়তা দান রমজানেরই শিক্ষা। এ মাস মুসলমানদের জন্য আত্মিক, আধ্যাত্মিক ও শারীরিক উন্নতির সুযোগ এনে দেয়। এমন এক মাসে দেশের সব মুসলমান ইসলামের শিক্ষা অনুযায়ী ত্যাগ ও কৃচ্ছ্রসাধনের মাধ্যমে ভ্রাতৃত্ব ও শান্তির আদর্শকে সমুন্নত রাখতে সচেষ্ট হবে।
রোজার গুরুত্ব সম্পর্কে আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘…সুতরাং তোমাদের মধ্যে যে ব্যক্তি এ মাস (রমজান) পাবে, সে যেন অবশ্যই রোজা রাখে। আর তোমাদের মধ্যে কেউ যদি অসুস্থ হয় বা সফরে থাকে, তবে অন্য সময় সে সমান সংখ্যা পূরণ করবে।’ (সুরা বাকারা, আয়াত : ১৮৫)
পবিত্র কোরআনে আল্লাহ তাআলা আরও বলেন, ‘হে ঈমানদাররা! তোমাদের ওপর রোজা ফরজ করা হয়েছে, যেমন ফরজ করা হয়েছিল তোমাদের পূর্ববর্তীদের ওপর; যাতে তোমরা তাকওয়া অবলম্বনকারী হতে পারো।’ (সুরা বাকারা, আয়াত : ১৮৩)
মহানবী (সা.) বলেছেন ”যারা পবিত্র রমজান পেয়েও তাদের গুনাহ মাফ করাতে পারেন নি, তারা অভিশপ্ত”। কাজেই এব্যাপারে সকলেরই সতর্ক হওয়া প্রয়োজন।
আমরা মুসলমান। নবীজি (সা.) বলেন, ‘আল্লাহর কসম! মুসলমানদের জন্য রমজানের চেয়ে উত্তম কোনো মাস আসেনি এবং মুনাফিকদের জন্য রমজান মাসের চেয়ে অধিক ক্ষতির মাসও আর আসেনি। কেননা মুমিনরা এ মাসে (সারা বছরের জন্য) ইবাদতের শক্তি ও পাথেয় সংগ্রহ করে। আর মুনাফিকরা তাতে মানুষের উদাসীনতা ও দোষত্রুটি অন্বেষণ করে। এ মাস মুমিনের জন্য গনিমত আর মুনাফিকের জন্য ক্ষতির কারণ।’ (মুসনাদে আহমদ, হাদিস : ৮৩৬৮)
এই দুনিয়াটা পরীক্ষার ক্ষেত্র। আমাদের সবাইকে মরতে হবে। আমরা মুনাফিক হয়ে নয়, মুসলমান হয়ে মরতে চাই। আমরা যেন আল্লাহর রহমত থেকে বঞ্চিত না হই। পবিত্র মাহে রমজানের মহত্ব উপলব্ধি করার তৌফিক যেন আল্লাহ পাক আমাদের দান করেন। আমিন