আইরিশ বাংলাপোষ্ট অনলাইন ডেস্কঃ ভারতের বেঙ্গালুরুতে তিন মাসের নির্মম নির্যাতন ও বন্দীদশা থেকে পালিয়ে আসা এক কিশোরীর মামলায় তিনজনকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। গ্রেফতারকৃত তিনজনের মধ্যে মেহেদী হাসান বাবু (৩৫) নামে এক আসামি একাই ১ হাজার নারীকে পাচার করেছেন বলে জানা গেছে। বুধবার (২ জুন) রাজধানীর শ্যামলীতে নিজ কার্যালয়ে তেজগাঁও বিভাগের উপ-কমিশনার (ডিসি) মো. শহিদুল্লাহ সাংবাদিকদের এসব চাঞ্চল্যকার তথ্য জানিয়েছেন।
মো. শহিদুল্লাহ বলেন, গ্রেফতার হওয়া মেহেদী হাসান বাবু (৩৫) মামলার ভিকটিমসহ এক হাজারের বেশি নারী পাচারে জড়িত বলে স্বীকার করেছে। তিনি প্রায় ৭/৮ বছর ধরে মানব পাচারে জড়িত। তার কাছ থেকে উদ্ধারকৃত মোবাইল ও ডায়েরিতে হৃদয় বাবু, সাগর, সবুজ, ডালিম ও রুবেলের ভারতীয় মোবাইল নাম্বার পাওয়া গেছে। পাশাপাশি তার কাছ থেকে উদ্ধারকৃত ডায়েরিতে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হওয়া ভিডিওর ভিকটিম জেসমিন মীমের নাম্বার ও ভারতে পাচারকৃত উল্লেখযোগ্য সংখ্যক ভিকটিমের নাম ও মানব পাচারে জড়িত ব্যক্তিদের ডিটেইলস তথ্য পাওয়া গেছে।
এর আগে ভারতের বেঙ্গালুরুতে তিন মাসের নির্মম নির্যাতন ও বন্দীদশা থেকে পালিয়ে আসা এক কিশোরীর মামলায় তিনজনকে গ্রেফতার করে পুলিশ। সাতক্ষীরার সীমান্তবর্তী দাবকপাড়া কালিয়ানী এলাকা থেকে ওই তিনজনকে গ্রেফতার করা হয়।
উপ-কমিশনার (ডিসি) মো. শহিদুল্লাহ বলেন, মামলার বাদীসহ তিনজন তরুণী বেঙ্গালুরু থেকে পালিয়ে এসেছে। তারা শুনিয়েছেন পাচারের শুরু থেকে পালিয়ে আসা পর্যন্ত লোমহর্ষক কাহিনী।
তরুণীর বর্ণনার বরাত দিয়ে ডিসি বলেন, পাচার হওয়া এই তরুণীর সাথে ২০১৯ সালে হাতিরঝিলে মধুবাগ ব্রিজে আসামি হৃদয় বাবুর পরিচয় হয়। টিকটক স্টার বানাতে চেয়ে বা ভালো বেতনের চাকরির অফার দিয়ে ভিকটিমকে প্রলুদ্ধ করার চেষ্টা করে হৃদয় বাবু। ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে নারায়ণগঞ্জের অ্যাডভেঞ্চার ল্যান্ড পার্কে ৭০-৮০ জনকে নিয়ে টিকটক হ্যাংআউট এবং ২০২০ সালের ১৮ সেপ্টেম্বর গাজীপুরের আফরিন গার্ডেন রিসোর্টে ৭/৮শ’ তরুণ-তরুণীকে নিয়ে পুল পার্টির আয়োজন করে হৃদয় বাবু। পরে ২০২১ সালের ১৯ ফেব্রুয়ারি কুষ্টিয়ায় লালন শাহ মাজারে আয়োজিত টিকটিক হ্যাংআউটে নিয়ে যাওয়ার কথা বলে আন্তর্জাতিকভাবে সক্রিয় এই মানব পাচারকারির চক্রের অন্যান্য সহযোগীদের সহায়তায় কৌশলে ভিকটিমকে ভারতে পাচার করে হৃদয় বাবু। পাচারকারি চক্রের খপ্পরে পড়ার পর থেকে পালিয়ে দেশে ফেরা পর্যন্ত তারা চরম নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। যা লোমহর্ষক কল্প কাহিনিকেও হার মানায়।
জানা গেছে, ভারতে পাচারের পর ভিকটিমকে ব্যাঙ্গালুরুর আনন্দপুর এলাকায় পর্যায়ক্রমে কয়েকটি বাসায় রাখা হয়। এ সময় তারা পাচার হওয়া আরও কয়েকজন বাংলাদেশি ভিকটিমকে সেখানে দেখতে পান। তাদেরকে সুপার মার্কেট, সুপার শপ বা বিউটি পার্লারে ভালো বেতনে চাকরির প্রলোভনে পাচার করা হয়।
ডিসি বলেন, ভারতে পাচারের ৭৭ দিন পর হাতিরঝিল থানায় অভিযোগকারী ভিকটিমসহ আরও দুইজন পালিয়ে বাংলাদেশ আসেন।
ডিসি আরও বলেন, এই মামলায় এজাহারনামীয় ১২ আসামির মধ্যে পাঁচজন বাংলাদেশে অবস্থান করছেন, এমন তথ্য পেয়ে অভিযানে নামে পুলিশ। অভিযানে মঙ্গলবার (১ জুন) রাত সাড়ে ১০ টার দিকে সাতক্ষীরা জেলার সীমান্তবর্তী দাবকপাড়া কালিয়ানী এলাকা থেকে তিনজন আসামিকে গ্রেফতার করা হয়। এ সময় তাদের কাছ থেকে ভিকটিমকে পাচারের ব্যবহৃত দুটি মোটরসাইকেল, একটি ডায়েরি, চারটি মোবাইল ফোন ও একটি ভারতীয় সীম কার্ড উদ্ধার করা হয়।
গ্রেফতার হওয়া অপর দুই আসামি মহিউদ্দিন ও আব্দুল কাদের আলোচ্য ভিকটিমসহ পাঁচ শতাধিক ভিকটিমকে সীমান্তের শেষ প্রান্তে ভারতীয় দালালের হাতে তুলে দেওয়ার কথা স্বীকার করেছেন।
প্রসঙ্গত, পাচার হওয়া ভাইরাল ভিডিও’র নির্যাতিতা নারীর সহায়তায় পালিয়ে আসা এক কিশোরী রাজধানীর হাতিরঝিল থানায় মানবপাচার প্রতিরোধ ও দমন আইনে মামলা করেছেন। মামলায় ১২ জনকে আসামি করা হয়।
বস রাফিসহ ৪ জন রিমান্ডে:
ভারতে নারী পাচার ও যৌনকর্মে বাধ্য করার অভিযোগে দায়ের করা মামলায় গ্রেফতার আন্তর্জাতিক পাচারকারী চক্রের মূল হোতা আশরাফুল ইসলাম রাফি ওরফে ‘বস রাফি’সহ চারজনের পাঁচ দিন করে রিমান্ড মঞ্জুর করেছেন আদালত।
বুধবার বিকালে ঢাকার মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট বেগম ইয়াসমিন আরা এ আদেশ দেন।
রাজধানীর হাতিরঝিল থানার দায়ের করা মামলায় তদন্ত কর্মকর্তা মোহাম্মদ মহিউদ্দিন ফারুক আসামিদের আদালতে হাজির করে প্রত্যেকের ১০ দিন করে রিমান্ডের আবেদন করেন। শুনানি শেষে বিচারক তাদের ৫ দিন করে রিমান্ড মঞ্জুর করেন।
মামলায় রাফি ছাড়া অন্য আসামিরা হলেন- আব্দুর রহমান শেখ, ইসমাইল সরদার ও মোছা. সাহিদা বেগম।
ভারতে পাচার হওয়া ভুক্তভোগী তরুণীর বাবা ২৭ মে রাজধানীর হাতিরঝিল থানায় মানবপাচার আইন ও পর্নোগ্রাফি আইনে একটি মামলা করেন। ওই মামলায় টিকটিক হৃদয়সহ অজ্ঞাতনামা আরও চারজনকে আসামি করা হয়। এরই প্রেক্ষিতে র্যাব ঘটনার ছায়া তদন্ত শুরু করে।
টিকটক হৃদয় বাবুর সহযোগী যশোরের :
চাঞ্চল্যকর ভারতের বেঙ্গালুরুতে বাংলাদেশি তরুণীকে নির্যাতনের ভাইরাল ভিডিওতে টিকটক হৃদয় বাবুর সহযোগী যশোরের এক যুবকের নাম এসেছে। ভিডিও প্রচার হওয়ার পর আলামিনের (২৪) বাড়ি যশোর শহরের চাঁচড়া মধ্যপাড়া এলাকায় তোলপাড় সৃষ্টি হয়েছে।
অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (ক সার্কেল) বেলাল হোসাইন বলেন, ভারতের তরুণী নির্যাতনের ভিডিও ভাইরালের ঘটনায় জড়িত কারও বাড়ি যশোরে এমন তথ্য তারা নিশ্চিত হতে পারেননি। এ ব্যাপারে গোয়েন্দা তৎপরতা চলছে বলে তিনি জানান।
ঘটনাটি প্রচারের পর নির্যাতনের শিকার তরুণীর পিতা ঢাকার হাতিরঝিল থানায় মানবপাচার ও পর্ণোগ্রাফি নিয়ন্ত্রণ আইনে একটি মামলা করেছেন। তরুণীটিকে পাচার করে নিয়ে যাওয়ার মূল হোতা টিকটক হৃদয় বাবুর পরিচয়ও নিশ্চিত হওয়া গেছে।
ভিডিওটি প্রচার হওয়ার পর নির্যাতনকারী চক্রের মধ্যে যশোরের আলামিন নামের এক যুবকও রয়েছে। যশোরের চাঁচড়া মধ্যপাড়া এলাকার ভ্যানচালক মনুমিয়ার ছেলে আলামিন। এ ব্যাপারে মনু মিয়া সাংবাদিকদের বলেন, আলামিন ভালো না। বাইরে থেকে আলামিনের কাছে লোক আসতো। ঘরে বসে তারা কিসব (ইয়াবা) খেতো। তাই আট মাস আগে তাকে বাড়ি থেকে বের করে দিয়েছি। শুনিছি, আলামিন ভারত গেছে, তার বউ বাপের বাড়ি। সেখানে সে কি করছে জানি না, তার সাথে আমাদের কোনো যোগাযোগ নেই।
স্থানীয় সূত্র জানিয়েছে, আগে থেকেই বেপরোয়া আলামিন দেশে দু’টি বিয়ে করেছে। দুই সংসারে তার দু’টি সন্তানও রয়েছে। তাদের ফেলে সে ভারতে চলে যায়। ভিডিওতে সে গোলাপি ফুলহাতা গেঞ্জি ও হাফপ্যান্ট পরিহিত এবং তার পায়ে কালো রাবারের ব্যান্ড রয়েছে।
সূত্র আরও জানিয়েছে, ভিডিওতে থাকা লাল ফুলহাতা টপস পরা মেয়েটির নাম তানিয়া। এই তানিয়ার বাড়ি যশোরের অভয়নগর উপজেলার বাঘুটিয়া গ্রামে। তানিয়াকে আলামিন স্ত্রী হিসেবে পরিচয় দিয়ে ভারতে নিয়ে গেছে। আলামিন বা তানিয়ার কেউই এখনও আটক হয়নি। তারা ওই এলাকায় পালিয়ে রয়েছে।
এদিকে, ভারতের একটি সূত্র জানিয়েছে, টিকটক হৃদয় বাবু, আলামিনসহ এই চক্রটি ভারতের বেঙ্গালুরুর কোর্টলোর এলাকায় থাকে। সেখানে ‘রাফি’ নামে একজনের আস্তানা রয়েছে। এই রাফির বাড়ি ঝিনাইদহের শৈলকুপায়। তার প্রকৃত নাম আশরাফুল মন্ডল। রাফিকে আলামিনরা বস বলে সম্বোধন করে।
জানা যায়, গত বছর ২৩ সেপ্টেম্বর আলামিন তানিয়াকে নিয়ে অবৈধপথে বেনাপোল দিয়ে ভারতে প্রবেশ করে। যাওয়ার আগে সে চাঁচড়া এলাকার ইয়াবা বিক্রেতা কামরুলের কাছ থেকে ১০ হাজার টাকার ইয়াবা কিনে নিয়ে যায়। ‘অরিজিনাল মাল’ হিসেবে ইয়াবাআসক্ত ‘রাফিকে’ উপহার দেয়ার জন্য এই ইয়াবা সে বেঙ্গালুরু নিয়ে যায়।
ভারতের সূত্রটি আরও জানায়, নির্যাতনে জড়িত আলামিন ও তানিয়া গাঢাকা দিয়েছে। এছাড়া ডালিম ও সবুজ নামে আরও দুই যুবক ছিল, তারাও পালিয়ে গেছে। বেঙ্গালুরু পুলিশ তাদের খুঁজছে।
এদিকে, ভাইরাল ভিডিও নিয়ে কথা হয় চাঁচড়া মধ্যপাড়া এলাকার বেশ কয়েকজন বাসিন্দার সঙ্গে। তারা জানান, এলাকায় এটি জানাজানি হওয়ার পর অনেকে আলামিনের পরিবারের সদস্যদেরও বিষয়টি জানিয়েছেন। এটি নিয়ে বাড়ির লোকজনও চাপের মধ্যে রয়েছে। স্থানীয় পুলিশও বিষয়টির ব্যাপারে খোঁজখবর করছে। তারা ওই ঘটনায় জড়িতদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি জানিয়েছেন।
আরেক অভিযুক্ত পালাতে গিয়ে গুলিবিদ্ধ
ভারতে কয়েকজন মিলে এক তরুণীকে বিবস্ত্র করে নির্যাতন ও ভিডিও ভাইরালের ঘটনায় আরেক অভিযুক্ত পুলিশের গুলিতে আহত হয়েছে। বুধবার তাকে গ্রেপ্তার করতে গেলে সে পুলিশের ওপর হামলা চালিয়ে পালানোর চেষ্টাকালে গুলিবিদ্ধ হয় বলে জানিয়েছে বেঙ্গালুরু পুলিশ।
এ ঘটনায় অপর দুই অভিযুক্ত পালানোর চেষ্টাকালে সিটি পুলিশের গুলিতে আহত হওয়ার কয়েক দিন পর এ ঘটনা ঘটল। এ ঘটনায় এখনও পর্যন্ত ১০ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। খবর এনডিটিভির
পুলিশ জানায়, গোপনে খবর পেয়ে বুধবার সকালে বেঙ্গালুরু পুলিশের একটি দল ওই অভিযুক্তকে গ্রেপ্তার করতে যায়। এ সময় পুলিশ দেখে সে ছুরি নিয়ে তাদের আক্রমণ করে এবং পালানোর চেষ্টা করে। পুলিশ আত্মরক্ষার্থে গুলি চালিয়ে তাকে ধরে ফেলে।
হামলায় পুলিশের একজন কনস্টেবলের গুরুতর আহত হন। তাকে ও গ্রেপ্তার অভিযুক্তকে চিকিৎসার জন্য হাসপাতালে নেওয়া হয়েছে।
সম্প্রতি কয়েকজন মিলে বাংলাদেশি ওই তরুণীকে বিবস্ত্র করে নির্যাতনের ভিডিও ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়ে। ভিডিওটি ভাইরাল হলে বাংলাদেশ ও ভারতে তৈরি হয় ব্যাপক প্রতিক্রিয়া। অভিযুক্তদের গ্রেপ্তারের দাবি ওঠে। প্রথমে আসাম পুলিশ নির্যাতনকারীদের ছবি টুইট করে তাদের ধরিয়ে দিতে পুরস্কার ঘোষণা করে। পরে তাদের দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে বেঙ্গালুরু পুলিশ প্রথমে ছয়জনকে গ্রেপ্তার করে। ঘটনাস্থল পরিদর্শনকালে পালানোর চেষ্টা করলে পুলিশের গুলিতে তাদের দু’জন আহত হন।
নির্যাতনের শিকার মেয়েটির বাবা ঢাকার রাস্তায় ডাব বিক্রি করেন। তার মেয়ে কিভাবে এখন ভারতে তা তিনি জানেন না। বছরখানেক থেকে মেয়ের সঙ্গে তার যোগাযোগ নেই বলে জনিয়েছেন।
এদিকে বেঙ্গালুরু পুলিশ বলছে, ওই তরুণীকে সংযুক্ত আরব আমিরাতের দুবাই পাঠানো হয়েছিল, সেখানে তাকে দেহ ব্যবসায়ে ঠেলে দেওয়া হয়। প্রায় এক বছর হোটেলে নর্তকির কাজও করেন। কেরালা থেকে যারা মেয়েটিকে উদ্ধার করেন তারা বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।
বেঙ্গালুরু পুলিশ আরও জানায়, আমিরাত থেকে কয়েক মাস আগে দূর সম্পর্কের আত্মীয় মোহাম্মদ বাবা শেখ মেয়েটিকে ভারতে এনে পতিতিবৃত্তিতে বাধ্য করেন। বাবা শেখ ভুক্তভোগী মেয়েটির এক দূর সম্পর্কের আত্মীয়কে বিয়ে করেছেন। নির্যাতনের ঘটনায় বাবা শেখের স্ত্রীও গ্রেপ্তার হয়েছেন। এই বাবা শেখ ও তার সহযোগীরা বাংলাদেশ থেকে তরুণীদের ভারতে বিউটি পার্লারে বা গৃহকর্মীর কাজ দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে কর্ণাটক, তেলেঙ্গানা ও কেরালায় নিয়ে পতিতাবৃত্তিতে বাধ্য করে আসছিলেন। ভুক্তভোগী তরুণীকে ফাঁদে ফেলে এই দলে যোগ দিতে বাধ্য করা হয়েছিল।