আইরিশ বাংলা পোস্ট ডেস্কঃ বাংলাদেশের নির্বাচন কমিশনারদের পাল্টাপাল্টি বক্তব্য প্রকাশিত হয়েছে। নির্বাচন কমিশনার মাহবুব তালুকদার বলেছেন, “বর্তমান নির্বাচন কমিশনের মেয়াদ যতই ফুরিয়ে আসছে, নির্বাচন ব্যবস্থা ও অবস্থা দেখে ততই উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ছি। প্রকৃত পক্ষে নির্বাচন এখন আইসিইউতে। এর পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া হিসেবে গণতন্ত্র এখন লাইফ সাপোর্টে। দেশে প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর অসহিষ্ণু মনোভাব গণতন্ত্রকে অন্তিম অবস্থায় নিয়ে গেছে। খেলায় যেমন পক্ষ-বিপক্ষের প্রয়োজন হয়, তেমনি একপক্ষীয় কোনো গণতন্ত্র হয় না। বহুদলীয় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য যেকোনো মূল্যে গণতন্ত্রকে আমরা লাইফ সাপোর্ট থেকে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়ে আনতে চাই। এজন্য দলমত নির্বিশেষে ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টা প্রয়োজন। এই সংকট নিরসনে সকল দলের সমঝোতা অপরিহার্য।”
মাহবুব তালুকদার বলেন, সংবিধানের বাধ্যবাধকতা সত্ত্বেও সুদীর্ঘ ৫০ বছরে নির্বাচন কমিশন গঠন আইন করা হয়নি। নির্বাচন প্রক্রিয়া সংস্কারের জন্য এই আইন প্রণয়ন অবধারিত হলেও তা যথেষ্ট নয়। এতে নিরপেক্ষভাবে সব রাজনৈতিক দলের স্বার্থ সংরক্ষণ করা আবশ্যক এবং তা সকল দলের কাছে গ্রহণযোগ্য হওয়া বাঞ্ছনীয়। একপক্ষীয় আইন করে কোনো লাভ হবে না। একপক্ষীয় আইন কেবল একদলীয় শাসনের পথ উন্মুক্ত করে। বিষয়টির যত তাড়াতাড়ি ফয়সালা হয়। ততই মঙ্গল। নইলে দেশব্যাপী নৈরাজ্যের আশঙ্কা আছে।
তিনি বলেন, এবারের ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনকে রক্তাক্ত নির্বাচন বললে অত্যুক্তি হবে না। নির্বাচনের সময় ও তার আগে-পরে এ পর্যন্ত ৩৯ জন নিহত হন। জীবনের চেয়ে নির্বাচন বড় নয় এই বার্তা সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিবর্গের কাছে পৌঁছাতে সম্ভবত ব্যর্থ হয়েছি। গত ১১ই নভেম্বর ৮৩৪টি ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এতে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় ৮০ জন চেয়ারম্যান পদে আসীন হন। একে আক্ষরিক অর্থে নির্বাচন বলা যায় না। যেখানে প্রতিদ্বন্দ্বিতা নেই, সেখানে নির্বাচন নেই। ইউপি নির্বাচন দলীয় ভিত্তিতে না হয়ে পূর্বের ন্যায় সবার জন্য উন্মুক্ত হলে ‘বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত’ হওয়ার সুযোগ থাকবে না।
মাহবুব তালুকদার বলেন, আমার মতে পৃথক একটি স্থানীয় নির্বাচন কর্তৃপক্ষ গঠন করে এসব নির্বাচন করা যায়। যে নির্বাচন প্রক্রিয়া নির্বাচন কমিশন ঠিক করে না, তার দায় কমিশন কেন নেবে? তবে এই পরিবর্তন রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের ব্যাপার।
তিনি আরও বলেন, জাতীয় ও স্থানীয় নির্বাচনের বড় সমস্যা হলো রিটার্নিং অফিসারগণকে রাজনৈতিক বাস্তবতার কারণে স্থানীয় সংসদ সদস্যদের কিংবা স্থানীয় নেতাদের প্রকাশিত ও অপ্রকাশিত মনোভাব অনুধাবন করে চলতে হয়। ফলে তারা হানাহানি, গোলযোগ ও আচরণবিধি লঙ্ঘনের অভিযোগগুলো ধামাচাপা দিতে চান। তাদের ধামাধরা না হয়ে উপায় থাকে না। বিভিন্ন নির্বাচনে রিটার্নিং অফিসারদের সঙ্গে কথা বলে আমার এই ধারণা হয়েছে। তাদেরকে নির্বাচনে সাহসী ভূমিকা পালনের কথা বলে লাভ নেই। স্থানীয় ক্ষমতাধরদের রোষানল থেকে রক্ষা করতে সাহসী রিটার্নিং অফিসার ও সাহসী কর্মকর্তাদের প্রয়োজনীয় সুরক্ষা বা নিরাপত্তা দেয়ার নজির নেই।
এদিকে নির্বাচন কমিশন নিয়ে কমিশনার মাহবুব তালুকদারের দেয়া বক্তব্য তথ্যভিত্তিক নয় বলে দাবি করেছেন আরেক নির্বাচন কমিশনার রফিকুল ইসলাম। অতীতের উদাহরণ ও পরিসংখ্যান উল্লেখ করে তিনি বলেছেন, বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় কেউ নির্বাচিত হলে সেখানে ইসির কিছু করার থাকে না। ইসি কর্মকর্তারা স্বাধীনভাবে কাজ করেছেন বলেই সরকার দলীয় প্রার্থীর বাইরে অনেকেই নির্বাচনে জয় পেয়েছেন। মাহবুব তালুকদারের বক্তব্য “নির্বাচন আই সিউ তে” কিংবা “গণতন্ত্র লাইফ সাপোর্টে” সম্পর্কে জনাব রফিকুল ইসলাম বলেন, মাহবুব তালুকদারের বক্তব্য তথ্যভিত্তিক মনে হয় না। তিনি যে প্রেক্ষাপটে বক্তব্য রেখেছেন তার কোনো ভিত্তি নেই।
মাহবুব তালুকদার বিনাপ্রতিদ্বন্দ্বিতায় জনপ্রতিনিধি নির্বাচিত হওয়ার বিষয়ে প্রশ্ন রেখেছেন।রফিকুল ইসলাম উল্টো প্রশ্ন রাখেন, বাংলাদেশের ইতিহাসে এমন একটা স্থানীয় নির্বাচন দেখান যেখানে বিনাপ্রতিদ্বন্দ্বিতায় একজন প্রার্থীও নির্বাচিত হননি। যদি প্রতিদ্বন্দ্বিতা না থাকে তবে নির্বাচন কমিশনের কিছু করার থাকে না। নিজের বক্তব্যের পক্ষে যুক্তি উপস্থাপন করে রফিকুল ইসলাম বলেন, বর্তমানে প্রার্থীদের নির্বাচন করতে হলে বহু রকম প্রতিবন্ধকতা মোকাবিলা করতে হয়। অনেক অর্থ খরচের বিষয়ও থাকে। এখন প্রার্থী হওয়ার আগে অনেকেই চিন্তা করে জিততে না পারলে অযথা কেন এসব প্রতিবন্ধকতা মোকাবিলা করবে। তখন তারা নির্বাচন থেকে সরে যায় এবং প্রতিপক্ষ বিনাপ্রতিদ্বন্দ্বিতায় জিতে যায়। সদ্য সমাপ্ত দ্বিতীয় ধাপের ইউপি নির্বাচনের উদাহরণ দিয়ে তিনি বলেন, এই নির্বাচনে প্রায় ৭টা রাজনৈতিক দল থেকে চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছে। বিএনপি আনুষ্ঠানিকভাবে নির্বাচনে অংশ না নিলেও তাদের মহাসচিব বলেছেন, কেউ যদি স্বতন্ত্র নির্বাচন করতে চায় তাহলে সে করতে পারে। এই নির্বাচনে দেখা গেছে, বেশ কয়েকজন বিএনপি’র চিহ্নিত নেতা নির্বাচনে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে অংশ নিয়েছেন এবং জয়ও পেয়েছেন। এ ছাড়া ৮৩৪টি ইউপির মধ্যে প্রায় ৪ শতাধিক ইউপিতে সরকারদলীয় প্রার্থীর বাইরে চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছে। মাহবুব তালুকদারের বক্তব্য সঠিক হয়ে থাকে তবে সরকারদলীয় প্রার্থীর বাইরে এত প্রার্থী কীভাবে জয়লাভ করে? সুতরাং রিটার্নিং অফিসারদের কাজের স্বাধীনতা নিয়ে মাহবুব তালুকদার যে বক্তব্য দিয়েছেন তাও সঠিক নয়। নির্বাচন কমিশন নিয়ে মাহবুব তালুকদারের শব্দ চয়ন নিয়েও আপত্তি রয়েছে বলে জানান রফিকুল ইসলাম।
নির্বাচন কমিশনার মাহবুব তালুদারের কমিশন সম্পর্কে এধরনের মন্তব্য আমরা আগেও দেখেছি। তবে এধরনের পাল্টাপাল্টি বক্তব্য নির্বাচন কমিশনের অভ্যন্তরের অসুস্থ পরিবেশের ইংগিত বহন করে। এমনিতেই নির্বাচন কমিশন আস্থাহীনতায় ভুগছে এর মধ্যে যদি নির্বাচন কমিশনারের মত দায়িত্বশীল পদে থেকে পাল্টা পালটি বক্তব্য দেয়া হয় তাহলে কোনভাবেই দেশের সুস্থ পরিবেশের বার্তা বহন করেনা। যখন একজন নির্বাচন কমিশনার, “প্রকৃতপক্ষে নির্বাচন এখন আই সি ইউ তে ” কিংবা “গণতন্ত্র এখন লাইফ সাপোর্টে” এধরনের বক্তব্য দেন তখন একদিকে যেমন নির্বাচন সম্পর্কে কমিশন এবং রাষ্ট্রের সকল ব্যর্থতা প্রকাশিত হয়ে পড়ে, অন্যদিকে তিনি নিজে নির্বাচন কমিশনার থেকে এই বক্তব্য সম্পুর্ন স্ববিরোধী হয়ে জনমনে বিভিন্ন ধরনের প্রশ্নের জন্ম দেয়।