বিজয়ের উনপঞ্চাশ বছর

ডাঃ জিন্নুরাইন জায়গীরদারঃ আজ ১৬ই ডিসেম্বর বাঙালী জাতির পরম আনন্দ, সৌভাগ্য আর গৌরবোজ্জ্বল দিন। আজ থেকে উনপঞ্চাশ বছর আগে স্বচেতন, লড়াকু, বীর বাঙালী জাতি ছিনিয়ে এনেছিল স্বাধীনতার উজ্জ্বল পতাকা। পদানত করেছিলো হানাদার, পাষণ্ড ও সীমার পাকিস্তানী সশস্ত্র সামরিক বাহিনীকে। পাকিস্তান সামরিক বাহিনীর কমান্ডিং অফিসার লেঃ জেনারেল আমির আব্দজুল্লাহ খান নিয়াজী, ৯৩,০০০ সৈনিক সহ আত্নসমর্পন করেছিলো ঢাকার রমনা রেইস কোর্স ময়দানে।

উনপঞ্চাশ বছর পূর্নতার এই গৌরবোজ্জ্বল দিনে আমরা কৃতজ্ঞচিত্তে স্মরণ করি সেই সব বীর আর বীরাঙ্গনাদের, যাদের জীবন আর সম্ভ্রমের বিনিময়ে স্বাধীনতার লাল সূর্য্য ছিনিয়ে আনা সম্ভব হয়েছিলো। হানাদার পাকিস্তানী বাহিনীর ২৪ বছরের অত্যাচার, অবিচার আর অনাচারের কালো ইতিহাস আমাদের মানসপটে চিরজাগরুক থাকবে। ত্রিশ লক্ষ শহীদের রক্ত আর মা বোনের সম্ভ্রম আমাদের মস্তক উন্নত করে ধরেছে বিশ্ব পরিমণ্ডলে। তাদের জন্য আমাদের সশ্রদ্ধ সালাম আর প্রার্থনা।

Bangladesh celebrating 49th Victory Day

পাকিস্তানী হায়েনারা আমাদের গণতান্ত্রিক অধিকার হরণ করতে চেয়েছিল, তারা চেয়েছিল কন্ঠরুদ্ধ করে আমাদের ভাষা কেড়ে নিতে কিন্তু সেদিনের লড়াকু বাঙালীরা সেটা মেনে নেয়নি, গর্জে উঠেছিলো বঙ্গবন্ধুর আহবানে আর নেতৃত্বে। ৭ই মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণে বঙ্গবন্ধু ঘোষণা করেছিলেন, “আজকের সংগ্রাম আমাদের স্বাধীনতার সংগ্রাম , আজকের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম”; তিনি বলেছিলেন, “যার যা আছে তাই দিয়ে তোমরা শত্রুর মোকাবেলা করো”। তার নির্দেশে এই জাতি মোকাবেলা করেছিলো, বুকের তাজা রক্ত দিয়ে আর ছিনিয়ে এনেছিলো লাল সবুজের পতাকা।

আজ মহান বিজয় দিবস - পাহাড়ের আলো


২৪ বছরের আন্দোলন আর ৯ মাসের মুক্তিযুদ্ধের ফসল আমরা কতটুকু ঘরে তুলতে পেরেছি প্রতিমুহূর্তে সেটা ভেবে দেখা আমাদের দায়িত্ব, বিশেষ করে আজকের এই পঞ্চাশতম নিজয় দিবসে ভেবে দেখা উচিত এক সাগর লাল রক্তের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীনতা আর স্বার্বভৌমত্ত, ভাষা আর চিন্তা, সম্মান আর প্রগতি কতটুকু আমরা ধারণ করতে পেরেছি আর তারপর আমাদের অগ্রগতি হয়েছে কতটুকু? কি হারিয়ে আমরা কি পেয়েছি? আর যা পেয়েছি তার কতটুকু ধারণ করেছি উন্নত মস্তকে।

স্বাধীনতার পর আমরা কি হারিয়েছি? স্বাধীনতা অর্জনের অব্যবহিত পরেই আমরা হারিয়েছি স্বাধীনতা মূল স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানসহ জাতীয় চার নেতাকে অসময়ে এবং অপ্রত্যাশিত দুর্ঘটনায়। অনাকাঙ্ক্ষিত এ বিদায় স্বাধীনতার সম্মান আর অর্জনকে ধূলায় লুণ্ঠিত করে দিয়েছিলো, এরপর আবার আমরা হারিয়েছি স্বাধীনতার ঘোষক এবং পরবর্তিতে রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানকে। এই হারিয়ে যাওয়ার পন্থা ছিল অপ্রত্যাশিত এবং অগ্রহণযোগ্য। স্বাধীনতার পর আমরা গণতন্ত্রকে হারিয়েছি বারে বারে। একনায়কতন্ত্র আর সামরিক শাসন এসে বারে বারে আমাদের চেতনা আর অগ্রগতিকে রুখে দিয়েছে। ফলশ্রুতিতে দুর্নীতি স্বজনপ্রীতি, দলীয়করণ আর মূল্যবোধের অবক্ষয় জাতির ললাটে কালো তিলক একে দিয়েছে।

আমরা কি পেয়েছি? বাংলাদেশের জনসংখ্যা সাড়ে ৭ কোটী থেকে বেড়ে আজ হয়েছে প্রায় ১৭ কোটি, অর্থনৈতিক উন্নয়ন হয়েছে আশাতীত বিশ্বের পাতায় বাংলাদেশ আজ আর সেই তলাবিহীন ঝুড়ি নয়। ইন্টার্নেশনাল মনিটারি ফান্ডের ভবিষ্যদ্বাণী অনুসারে আগামী বছর বাংলাদেশের জি ডি পি (পার ক্যাপিটা) ভারতকে অতিক্রম করতে সক্ষম হবে। এছাড়া হেলথ ডেলিভারি ইনডেক্সে যা ৯০ এর দশকে ০.৪ ছিল তা বেড়ে গিয়ে আজ ০.৬৮১ এ এসে দাঁড়িয়েছে। এছাড়া গড় আয়ু হয়েছে ৭৩ বছর, বয়স্ক শিক্ষার হার এসে দাঁড়িয়েছে প্রায় ৭৪%, দারিদ্র কমে এসেছে উল্লেখযোগ্য। আরও অনেক সাফল্যগাথা আমাদের আছে।

সেই হিসেবে সফলতা আর ব্যর্থতা দুটোই আমাদের পাশাপাশি হাঁটছে, কিন্তু এই সফলতার হার আরও অনেক বেশী হতে পারত যদি আমরা আমাদের ঐক্যকে ধারণ করতে পারতাম, গণতন্ত্রকে শক্তিশালী করে মুক্তচিতা আর মুক্তবুদ্ধির চর্চা করতে পারতাম। আমরা আমাদের মূল্যবোধকে জাগ্রত করে দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি আর দুরাচারকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারতাম। পরিশেষে পঞ্চাশতম বিজয়ের এই দিনে আমরা আহবান জানাবো, আসুন যেভাবে ১৯৭১ সালে আমরা ঐ ক্যবদ্ধ হয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে স্বাধীনতা এনেছিলাম আসুন আজ আবার ঐক্যবদ্ধ হই আর ছিনিয়ে আনি বিশ্বের দরবারে অগ্রগতি আর সম্মানের স্থান সুশাসন, সাম্য, বন্ধুত্ব্ব, প্রীতি আর ভালোবাসা হোক আমাদের পাথেয়।।




SHARE THIS ARTICLE