আইরিশ বাংলাপোষ্ট ডেস্কঃরাশিয়ার জনগণ ইতিমধ্যেই সাংবিধানিক সংস্কারের বিষয়ে ৭ দিনব্যাপী ভোট দেওয়া শুরু করেছেন। এই সংস্কার গৃহীত হলে, বর্তমান প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন আরও দু’বার প্রেসিডেন্ট পদে দায়িত্ব পালনের সুযোগ পাবেন, যা তাকে আরও ১৬ বছর ক্ষমতায় থাকার সুযোগ করে দেবে। গনভোট গ্রহণের জন্য ১লা জুলাই দিন নির্ধারিত ছিল, তবে কোভিড-১৯ মহামারীর কারণে জনাকীর্ণতা রোধ করতে এক সপ্তাহ আগে থেকে অর্থাৎ ২৫শে জুন বৃহস্পতিবার থেকেই ভোট কেন্দ্রগুলি চালু করা হয়েছে। কোভিড-১৯ সংক্রমণ বৃদ্ধির কারণে সরকারী নিষেধাজ্ঞা আরোপিত হলে ক্রামলিনের পক্ষ থেকে ২২শে এপ্রিলের নির্ধারিত এ গনভোট স্থগিত করা হয়েছিলো। এবছর জানুয়ারি মাসেই ১৯৯৩ সালের গৃহীত সংবিধানের সংস্কার চালু করা হয়েছে এবং তাত্ক্ষণিকভাবে সংসদ এবং আঞ্চলিক আইনসভা উভয় কক্ষেই এই সংস্কার গৃহীত হয়েছে।�বর্তমানে তার প্রেসিডেন্ট পদে থাকার মেয়াদ ২০২৪ সাল পর্য্যন্ত বলবত আছে। সাংবিধানিক এই সংস্কার গৃহীত হলে ৬ বছর মেয়াদি পদে একজন প্রেসিডেন্ট টানা দুই মেয়াদ হিসাবে দায়িত্ব পালন করতে পারবেন। এতে করে ২০২৪ সালের পর আরও টানা দুই মেয়াদ অর্থাৎ আরও ১২ বছর ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত থাকার বৈধতা পাবেন পুতিন। �বাল্টিক উপকূলে কালিনিনগ্রাদ থেকে প্রশান্ত মহাসাগরের কামচাটকা পর্যন্ত মোটামুটি ১ কোটি ১০ লক্ষ ভোটার ভোট দিতে পারবেন। কর্মকর্তারা সারাদেশে ভোটকেন্দ্রগুলিতে কোভিড-১৯ সংক্রমণ প্রতিরোধের লক্ষ্যে মাস্ক এবং হ্যান্ড স্যানিটাইজার সরবরাহ করছেন।�রাশিয়ার বিরোধী দলের একজন শীর্ষস্থানীয় মিঃ নাভালনি এই ভোটকে “অভ্যুত্থান” এবং “সংবিধান লংঘন” বলে অভিহিত করেছেন। কেউ কেউ যুক্তি দেখান যে, মিঃ পুতিন ক্ষমতায় আঁকড়ে থাকার চেষ্টা করছেন বা উপযুক্ত উত্তরসূরির সন্ধান না পেলে নিজেকে প্রেসিডেন্ট হিসাবে দীর্ঘস্থায়ী কোরফার সুযোগ তৈরি করছেন। ৬৭ বছর বয়সী প্রাক্তন কেজিবি এজেন্ট রাশিয়ার রাষ্ট্রপতি এবং প্রধানমন্ত্রী হিসাবে ইতিমধ্যে সর্বমোট ২০ বছর ধরে ক্ষমতায় আছেন। সাম্প্রতিক বছরগুলিতে পেনশন ব্যবস্থায় অর্থনৈতিক লড়াই এবং গভীর বিতর্কিত সংস্কারের জন্য তাঁর জনপ্রিয়তার মাত্রা হ্রাস পেয়েছে। ভোট বিরোধী লোকদের স্বাক্ষর সংগ্রহের জন্য গঠিত একটি ওয়েবসাইট আদালত বন্ধ করে দিয়েছে।অনেক প্রবীণ রাজনীতিবিদরা পরিবর্তনের পক্ষে বেরিয়ে এসেছেন এবং পর্যবেক্ষকরা বিশ্বাস করেন যে এই পদক্ষেপটি পাস হবে তাতে সন্দেহ নেই। নতুন সংবিধানের অনুলিপিগুলি ইতিমধ্যে রাশিয়ান বইয়ের দোকানগুলিতে বিক্রয়ের জন্য বিতরণ করা হয়েছে। বৈশ্বিক মহামারী করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত এই দেশটি বিশ্বব্যাপী রেকর্ড সংক্রমণের শনাক্ত সংখ্যায় তৃতীয় সর্বোচ্চ অবস্থানে আছে। ইতিমধ্যে মোট শনাক্তের সংখ্যা ৬ লক্ষ ২০ হাজার ৭৯৪ জন এবং মৃতের সংখ্যা ৮,৭৮১ জন – যদিও সমালোচকরা বিশ্বাস করেন যে সত্যিকার মৃত্যুর সংখ্যা অনেক বেশি। উল্লেখযোগ্য যে, রাশিয়ার বর্তমান সংবিধান অনুসারে প্রেসিডেন্ট দেশের প্রধান অধিকর্তা আর প্রধানমন্ত্রী সরকার প্রধান। প্রভূত ক্ষমতার অধিকারী এই প্রেসিডেন্ট পদে প্রত্যক্ষ নির্বাচনে ৬ বছর মেয়াদের জন্য নির্বাচিত হয়ে থাকেন। একজন ব্যাক্তি একাধারে দুই মেয়াদের বেশী সময়ের জন্য প্রেসিডেন্ট পদে প্রতিদ্বন্দ্বী হতে পারেন না। ১৯৯১ সাল থেকে রাশিয়া আনুষ্ঠানিক ভাবে একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র। ২০১৯ সালে “দি ইকোনোমিস্ট ইন্টেলিজেন্স ইউনিট” এর জরীপ অনুসারে গণতান্ত্রিক সূচকে বিশ্বের ১৬৭টি দেশের মধ্যে রাশিয়ার অবস্থান ১৩৭ দেখানো হয়েছে। ১৯৯১ সালে জনগণের প্রত্যক্ষ ভোটে নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট হিসাবে প্রথম ক্ষমতায় অধিষ্টিত হন “বরিস ইয়েলেতসিন”। ১৯৯৯ সালে বরিস ইয়েলেতসিন অকস্মাৎ পদত্যাগ করলে তখনকার প্রধানমন্ত্রী “ভ্লাদিমির পুতিন” প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব গ্রহণ করেন এবং ২০০০ সালে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে বিজয় লাভ করে প্রথমবারের মত প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। �২০০০ সালে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়ে পুতিন কঠোর হস্তে চেচেন বিদ্রোহ দমন করেন যদিও উত্তর ককেশাসে এখনও বিক্ষিপ্ত সহিংসতা দেখা দেয়। ঐ সময়ে তেলের উচ্চমূল্য, প্রাথমিকভাবে দুর্বল মুদ্রা এবং বাড়তি অভ্যন্তরীণ চাহিদা মোকাবিলা করে ১৯৯৯ থেকে ২০০৮ সাল পর্যন্ত প্রতি বছর গড়ে ৭% হারে অর্থনীতির বিকাশ ঘটাতে সক্ষম হোন। ইতিমধ্যে রাশিয়ায় জীবনযাত্রার মান উন্নত হয়েছে এবং বিশ্বে রাশিয়ার প্রভাব পর্যায়ক্রমে যথেষ্ট বৃদ্ধি পেয়েছে । ২০০৮ সালের বিশ্ব অর্থনৈতিক সঙ্কট এবং তেলের মূল্য হ্রাসের পর, রাশিয়ার অর্থনীতি স্থবির হয়ে পড়ে এবং দারিদ্র্য আবারো বাড়তে শুরু করে। দীর্ঘ মন্দার পর, ২০১৭ সাল থেকে শক্তিশালী বৈশ্বিক প্রবৃদ্ধি,বিশ্ব বাজারে তেলের মূল্য বৃদ্ধির কারণে রাশিয়ার অর্থনীতি পুনরায় শক্তিশালী হতে শুরু করে। যদিও প্রেসিডেন্ট থাকাকালীন পুতিনের বহু সংস্কার পশ্চিমা দেশগুলিতে অগণতান্ত্রিক বলে যথেষ্ট সমালোচিত হয়েছে কিন্তু রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা এবং অর্থনৈতিক অগ্রগতির ব্যাপারে পুতিনের শক্তিশালী নেতৃত্ব রাশিয়ায় ব্যাপক প্রশংসা অর্জন করে। প্রেসিডেন্ট পুতিনের দুটি প্রধান আন্তর্জাতিকভাবে বিতর্কিত পদক্ষেপের একটি হচ্ছে ২০১৪ সালে “ক্রিমিয়া” কে রাশিয়ায় অন্তর্ভুক্তি। ২০১৪ সালে, বিপ্লবের ফলে ইউক্রেনের রাষ্ট্রপতি “ভিক্টর ইয়ানুকোভিচ”: পালিয়ে যাওয়ার পরে পুতিন রাশিয়ার পার্লামেন্টের অনুমোদন নিয়ে রাশিয়ার সেনাবাহিনী ইউক্রেনে মোতায়েনের মাধ্যমে ক্রিমিয়া দখল করেন। ১৬ই মার্চ ২০১৪ সালে ক্রিমিয়ায় গণভোটে ৯৭% ভোটে ক্রিমিয়ার জনগণ রাশিয়ায় অন্তর্ভুক্তির পক্ষে ভোট প্রদান করেছে দেখানো হলে ১৮ই মার্চে একটি চুক্তির মাধ্যমে আনুষ্ঠানিকভাবে “ক্রিমিয়া ও সেভাস্টোপোল” রাশিয়ার করতলগত হয়। বিশ্ব সম্প্রদায় এই গনভোটকে প্রত্যাখ্যান করে। ২০১৪ সালের ২৭ শে মার্চ জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের একটি সভায় ১০০ সদস্য রাষ্ট্রের ভোটে ক্রিমিয়ার রাশিয়ান সংযুক্তির বিরোধিতা করে একটি বাধ্যতামূলক নয় এমন প্রস্তাব গৃহীত হয়। যদিও রাশিয়ার বিরুদ্ধে নিরাপত্তা পরিষদে প্রস্তাবিত সকল পদক্ষেপ রাশিয়া কর্তৃক ভেটো প্রদানের কারণে ব্যার্থতায় পর্য্যবসিত হয়। পুতিনের দ্বিতীয় বিতর্কিত পদক্ষেপ ছিল ২০১৫ সালের সেপ্টেম্বর মাসে, সিরিয়ার গৃহযুদ্ধে সামরিক হস্তক্ষেপ। সিরিয়ার গৃহযুদ্ধের ক্ষেত্রে রাশিয়ার সামরিক হস্তক্ষেপ বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলির বিরুদ্ধে সামরিক সহায়তার জন্য সিরিয়ার সরকার কর্তৃক সরকারী অনুরোধের পরে গ্রহণ করা হয়। এই হস্তক্ষেপে প্রাথমিকভাবে উত্তর-পশ্চিম সিরিয়ায় লক্ষ্যবস্তু এবং সিরিয়া সরকার বিরোধী সংগঠন যথা “সিরিয়ান ন্যাশনাল কোয়ালিশন”, “ইসলামিক স্টেট অফ ইরাক এবং লেভান্ট (আই এস আই এল)” এবং “আল নুসরা” সহ বিভিন্ন সংগঠনের বিরুদ্ধে বিমান হামলার মাধ্যমে শুরু করা হয়। ২০১৫ সালের ১১ই অক্টোবর প্রচারিত একটি টেলিভিশন সাক্ষাত্কারে ভ্লাদিমির পুতিন বলেছিলেন যে সামরিক অভিযান আগে থেকেই প্রস্তুত ছিল; তিনি রাশিয়ার লক্ষ্যকে “সিরিয়ায় বৈধ শক্তিকে স্থিতিশীল করা এবং রাজনৈতিক সমঝোতার শর্ত তৈরি করা” হিসাবে সংজ্ঞায়িত করেছিলেন। ২০১৭ সালের শেষ নাগাদ, হস্তক্ষেপের ফলে সিরিয়া সরকারের জন্য উল্লেখযোগ্য লাভ হয়েছিল। ২০১৬ সালের মার্চ মাসে পালমিরা, ডিসেম্বরে আলেপ্পো ও ২০১৭ সালে দেইর এজ জোড় পুনর্দখল ছিল রাশিয়ার প্রত্যক্ষ মদদে সিরিয়া সরকারের বিরাট অর্জন। জানুয়ারী ২০১৭ সালের প্রথম দিকে, রাশিয়া সশস্ত্র বাহিনীর প্রধান ভ্যালারি গেরাসিমভ বলেছিলেন যে, সামগ্রিকভাবে, রাশিয়ান বিমানবাহিনী ১৯ হাজার ১৬০ টি যুদ্ধ মিশন চালিয়েছিল এবং “সন্ত্রাসীদের অবকাঠামো” -র উপর ৭১ হাজার বার আক্রমণ করেছিলো। ২০১৭ সালের সেপ্টেম্বরের শেষের দিকে এসওএইচআর জানিয়েছে যে রাশিয়ার বিমান হামলায় ৫৭০৩ জন সাধারণ নাগরিকের জীবনহানি ঘটে যার এক চতুর্থাংশ ছিল শিশু এছাড়া বিদ্রোহী আল নুশরা ফ্রন্টের ৩৯৯৩ এবং অন্যান্য বিদ্রোহী বাহিনীর ৪,২৫৮ জন নিহত হয়। রাশিয়ার এই সামরিক হস্তক্ষেপ আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষকদেরকে মেরুকরন করে দেয় । রাশিয়ার সাথে ঘনিষ্ট কূটনৈতিক ও অর্থনৈতিক সম্পর্কে যুক্ত দেশ যথা চীন, মিশর, ইরাক এবং বেলারুশ এই হস্তক্ষেপকে সমর্থন করেছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিকটবর্তী সরকারগুলির প্রতিক্রিয়া ছিল বিপরীত, অনেক সরকার রাশিয়ার এই হস্তক্ষেপের নিন্দা করে এবং বলে যে সিরিয়ার সরকারকৃত যুদ্ধাপরাধের সাথে রাশিয়ার মদদ আছে। হিউম্যান রাইটস ওয়াচ এবং অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল জানিয়েছে যে রাশিয়া যুদ্ধাপরাধ করছে এবং ইচ্ছাকৃতভাবে বেসামরিক লোকদের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত করেছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এই হস্তক্ষেপের জন্য রাশিয়াকে নিন্দা করে এবং অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে জাতিসংঘের কর্মকর্তারা রাশিয়ার এই হস্তক্ষেপের নিন্দা জানায় এবং বলে যে রাশিয়া যুদ্ধাপরাধ করছে। পুতিন কর্তৃপক্ষ অবশ্য এই বিবৃতিটিকে মিথ্যা ও রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বলে প্রত্যাখ্যান করে বলে যে সমালোচকরা “বর্বরতা” করছে। এদিকে বিদ্রোহী দলগুলিকে সমর্থনকারী সরকারগুলি রাশিয়ার এই পদক্ষেপের গুরুতর নিন্দা প্রকাশ করেছে। সিরিয়ার এই যুদ্ধ একবিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয় মারাত্নক যুদ্ধ হিসাবে বর্তমানে পরিগণিত। এই যুদ্ধ এখনো চলছে আর কতদিন এই যুদ্ধ চলবে কেউ জানেনা। এই জীবন ধ্বংসকারী যুদ্ধ আর কত জীবন কেড়ে নেব্যে তা শুধু ইতিহাস আমাদেরকে জানান দেবে। �অনেকেই প্রশ্ন করছেন, “তাহলে কি ভ্লাদিমির পুতিন এই গণভোটে নির্বাচনের মাধ্যমে আজীবনের জন্য প্রেসিডেন্ট হিসাবে থাকার বৈধতা নিয়ে নেবেন?” এটা যদি সত্যিই হয় এবং আপাতদৃষ্টে তাই প্রতীয়মান হচ্ছে, তাহলে এর প্রতিক্রিয়া এবং সুদূরপ্রসারী প্রভাব কি হবে সেটা দেখার জন্য আমাদের অপেক্ষায় থাকতে হবে। সংবাদ সূত্রঃ এ এফ পি, বিবিসি, আল জাজিরা