ডা. তাসনিম জারাঃ ধর্মীয় ভাবগাম্ভীর্যের সাথে রোজা পলন করে মুসলিমরা। ধর্মীয় রীতি পালনের পাশাপাশি রোজার স্বাস্থ্যগত উপকারিতা বিভিন্ন সময়ে আলোচানায় উঠে এসেছে। এ নিয়ে মুসলিম দেশগুলোর রয়েছে অসংখ্য গবেষণা।
রমাজান মাসে রোজার উপকারিতা নিয়ে আলোচনা করেছেন কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক চিকিৎসক তাসনিম জারা। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ঘরোয়া উপায়ে বিভিন্ন রোগের উপশম সম্পর্কে আলোচনা করে বেশ জনপ্রিয় এই বাংলাদেশি চিকিৎসক। ডা. তাসনিম জারা তার এক ভিডিওতে বলেন, হাজার হাজার বছর ধরে রোজা রেখে আসলেও এটি স্বাস্থ্যের জন্য কতটা ভালো নাকি খারাপ তা জানা ছিল না। তবে গত বিশ থেকে ত্রিশ বছরে এ নিয়ে বহু গবেষণা হয়েছে। এসব গবেষণায় রোজার অনেক বিস্ময়কর উপকারিতা জানা গেছে।
যে সকল উপকারিতা রয়েছে:
অটোফেজির মাধ্যমে তারুণ্য ধরে রাখা ও রোগ থেকে সুরক্ষা:
আমাদের সারা শরীরে ট্রিলিয়ন ট্রিলয়ন কোষ দিয়ে গঠিত। প্রত্যেকটা কোষ ছোট ছোট কারখানার মতো। এ প্রক্রিয়ায় কোষে বর্জ্য পদার্থের সৃষ্টি হয়। এ সকল বর্জ্য কোষ নিজেই অটোফেজি নামক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে অপসারণ ও আবার ব্যবহার উপযোগী করে তুলে। কোষকে সতেজ করে তুলে এবং তারুণ্য ধরে রাখতে সহায়তা করে। এই প্রক্রিয়া ঠিকভাবে না হওয়ার সাথে অ্যালজেইমার্স, পারকিনসনের মতো মস্তিষ্কের রোগগুলোর সম্পর্ক থাকতে পারে বলে গবেষণায় উঠে এসেছে। আমরা যখন সারাক্ষণ খাবারের মধ্যে থাকি তখন এই অটোফেজি প্রক্রিয়া দমে থাকে। অন্যদিকে রোজা অবস্থায় অটোফেজি বেড়ে যায়। এ সময় কোষগুলো অধিক হারে মেরামত হয়।
মেটাবলিক সুইচ করে চর্বি কমিয়ে ফেলা:
আমাদের শরীর চালানোর জন্য জ্বালনির প্রয়োজন হয়। শরীর সেটি খাবার থেকে বা আগে থেকে জমিয়ে রাখা এক প্রকার গ্লাইকুজেন বা চিনি থেকে নিয়ে থাকে। আমরা যখন রোজা থাকি তখন ১০-১২ ঘণ্টায় এটি সাধারণত শেষ হয়ে আসে। আমাদেরকে চালানোর জন্য তখন আগে থেকে জমানো চর্বিতে হাত দিতে হয়। এটাকে মেটাবলিক সুইচ বলে। সাম্প্রতিক গবেষণায় দেখা গেছে এ সুইচের মাধ্যমে বেশ কয়েকটি উপকার হওয়ার সম্ভাবনা আছে। আমাদের হার্ট ভালো রাখা, পেটের চর্বি কমা, রক্তচাপ কমা, রক্তে চিনির পরিমাণ কমার মতো বেশ কিছু উপকারী বিষয়।
পেটের স্বাস্থ্য ভালো হওয়া:
আমাদের নাড়ি ভুড়িতে অনেক অনেক জীবানুর বসবাস। যা আমাদের রোগ প্রতিরোধ বৃদ্ধিসহ অনেক ভাবে স্বাস্থ্যের জন্য উপকারী। না খেয়ে থাকলে আমাদের পেটে উপকারী জীবানুর সংখ্যা বাড়ে। অর্থাৎ উপকারী রোজা রাখলে এখানে উপকারিতা আছে।
ওজন কমা:
বাংলাদেশসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে করা ৩৫টি গবেষণা একত্রিত করে দেখা গেছে, রমজানে রোজা রাখলে গড়ে এক থেকে দেড় কেজি ওজন কমে।
রক্তে সুগারের মাত্রা নিয়ন্ত্রণ:
রক্তে সুগারের মাত্রা থেকে বুঝা যায়, পরবর্তীতে ডায়াবেটিস হওয়ার ঝুঁকি কেমন। নির্দিষ্ট পরিমাণের থেকে বেশি থাকলে ডায়াবেটিস হওয়ার ঝুঁকি বাড়ে। তুরষ্ক, ইরানসহ বিভিন্ন দেশের ১৬টি গবেষণায় দেখা গেছে রোজা রাখলে নারী-পুরুষ উভয়ের রক্তে সুগারের অবস্থা ভালো হয়েছে। ইন্দোনেশিয়ার এক গবেষকরা ২৮টি গবেষণার ফল পর্যবেক্ষণ করে দেখেছেন রোজা রাখা ব্যক্তিদের ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণেও উপকার রয়েছে।
রক্তে কোলেস্টেরল নিয়ন্ত্রণ:
আমাদের রক্তে একধরণের চর্বি থাকে যাকে কোলেস্টেরল বলে। কোলেস্টেরল অনেক বেশি পরিমাণে থাকলে রক্তনালীতে চর্বি জমে তা সরু হয়ে যেতে পারে। ফলে হার্ট অ্যাটাক-স্ট্রোকের ঝুঁকি বেড়ে যায়। রমাজানে রোজা রক্তের কোলেস্টেরল নিয়ন্ত্রণে আনতে সহায়তা করে। আরব-আমিরাত, বাহরাইন, সৌদি আরবের গবেষকরা সারাবিশ্বে করা ৯১টি গবেষণার ফল পর্যবেক্ষণ করে দেখেছে রোজায় কোলেস্টেরল আগের থেকে ভালো নিয়ন্ত্রণে এসেছে।
ব্লাড প্রেশার নিয়ন্ত্রণ:
২০১৯ সালে লন্ডনের পাঁচটি মসজিদে একটি গবেষণা হয়। যার নাম ‘লন্ডন রামাদান স্টাডিজ’। এতে রামজানের আগে পরে ব্লাড প্রেশার মেপে দেখা হয় কোনো তারতম্য আছে কি না। সেখানে দেখা যায়, উপরের ব্লাড প্রেশার গড়ে ৭ মিলিমিটার মার্কারি আর নিচেরটি ৩ মিলিমিটার মর্কোরি কমেছে। ভারত, পাকিস্তানসহ আরও ৩২টি দেশের গবেষণায় দেখা গেছে রমজানে ওজন না কমলে ব্লাড প্রেশার নিয়ন্ত্রণে উন্নতি আসে।