শোকে বিভোর নারায়নগঞ্জবাসী। কে থামাবে ঘরে ঘরে কান্নার রোল?

আইরিশ বাংলাপোষ্ট অনলাইন ডেস্কঃ নারায়ণগঞ্জের তল্লা বায়তুস সালাত জামে মসজিদের তিতাস গ্যাসের লিকেজ থেকে ভয়াবহ বিস্ফোরণে এ পর্যন্ত ২৭ জনের মৃত্যু হয়েছে। নিহত ও আহতরা সবাই তল্লা বায়তুস সালাত জামে মসজিদের আশেপাশের বাসিন্দা। আহত ও নিহতদের স্বজনদের আহাজারিতে পুরো তল্লা এলাকায় শোকের ছায়া নেমে এসেছে। ঘরে ঘরে বইছে শোকের মাতম আর কান্নার রোল। কে কাকে সান্ত্বনা দেবেন সেই ভাষা হারিয়ে ফেলেছেন। স্বাধীনতার পর একসঙ্গে এতো মানুষের মৃত্যু ও আহত হওয়ার ঘটনা এই প্রথম দেখলো তল্লাবাসী।নিহতদের স্মরণে এলাকাবাসী ঘরে ঘরে কালো পতাকা টানিয়েছে। লাশবাহী অ্যাম্বুলেন্স এলাকায় ঢুকলেই শত শত মানুষ ঘিরে ধরছে। শোকগ্রস্ত তল্লাসহ পুরো নারায়ণগঞ্জ

সাব্বির (২১), জুবায়ের (১৮), ইয়াসিন (১২)। তারা তিন ভাই। তাদের বাসা নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লার পশ্চিম তল্লা এলাকায়। তাদের বাবা নূর উদ্দিন নারায়ণগঞ্জ প্রেসক্লাবের কর্মচারী। অনেক কষ্ট করে সাব্বির ও জুবায়েরকে কলেজে পড়াচ্ছিলেন। এদের মধ্যে সাব্বির সরকারি তোলারাম কলেজের অনার্সের শিক্ষার্থী। জুবায়ের নারায়ণগঞ্জ কলেজের দ্বাদশ শ্রেণির ছাত্র। ইয়াসিন স্থানীয় প্রাইমারি স্কুলে পড়ে। নূর উদ্দিন প্রেসক্লাবে তার ডিউটি শেষে পশ্চিম তল্লা এলাকায় মুদি দোকানদারি করেন। নিজে নিরক্ষর হলেও তিন সন্তানকে মানুষ করার স্বপ্ন ছিল তার। এক বিস্ফোরণে তার সেই স্বপ্ন শেষ হয়ে গেল। শুক্রবার মসজিদে বিস্ফোরণে মারা যায় তার বড় দুই ছেলে।

শুক্রবার এশার নামাজ আদায় করতে তিন ভাই বায়তুস সালাত জামে মসজিদে যায়। সাব্বির ও জুবায়ের মসজিদের সামনের কাতারে ছিলেন। ইয়াসিন দাঁড়িয়েছিল প্রবেশ কক্ষের শেষ কাতারে। নামাজ শেষে ইয়াসিন মসজিদ থেকে বের হতেই বিস্ফোরণ।

ইয়াসিন জানায়, বিস্ফোরণের পর দৌড় দিয়ে সে মসজিদের সামনের রাস্তার পানিতে পড়ে যায়। এর কিছু সময় পর সে দেখতে পায় যে দগ্ধ কয়েক জনকে ধরাধরি করে মসজিদ থেকে বের করা হচ্ছে। এর মধ্যে তার দুই ভাইকে দগ্ধ অবস্থায় সে দেখতে পায়। তার দুই ভাইকে অন্যরা ধরাধরি করে রিকশায় তুলে দেয়।

নূর উদ্দিন বলেন, ‘আমি ছোট চাকরি করি। আমি অনেক কষ্ট করে তাদের পড়াশুনা করাচ্ছিলাম। আল্লাহ আমার কপালে সুখ রাখল না। আমি কী অপরাধ করেছি যে আমার দুইটা শিক্ষিত ছেলেকে এভাবে নিয়ে যেতে হবে। আমি কার কাছে বিচার চাইব।’

বায়তুস সালাত জামে মসজিদ থেকে প্রায় ৫শ’ গজ দূরে তল্লা খামারবাড়ি এলাকায় একটি টিনশেড রুম নিয়ে ভাড়া থাকেন ডেকোরেটর কর্মচারী স্বপন মিয়া। তিন ছেলেমেয়ের মধ্যে মেজ সিফাত। এবার এসএসসি পাস করেছে। কিন্তু আর্থিক অসচ্ছলতার কারণে একটি গার্মেন্টস কারখানায় কাজ নিয়ে টাকা জোগাড় করছিলেন এইচএসসিতে ভর্তি হওয়ার জন্য। শুক্রবার রাতে মসজিদে নামাজ পড়তে গিয়ে বিস্ফোরণে ঝলসে যায় তার পুরো শরীর। কিন্তু পরিবারের আর্থিক অবস্থা এতটাই নাজুক যে ছেলেকে ঢাকা মেডিক্যালে গিয়ে দেখবে সেই পরিবহন ভাড়াটুকু পর্যন্ত নেই। তাই ঘরে বসেই দোয়া করছেন আর বিলাপ করে কাঁদছেন মা। আর বলছেন হাতে মাত্র ৫০ টাকা আছে। ঘরে চাল নেই যে এক বেলা রান্না করে খাবেন। তিনি বলেন, ছেলেটার কী অবস্থা, টাকার জন্য দেখতে যেতে পারছি না।

এদিকে নয়ন (২৬) নামে এক যুবক শুক্রবার রাতে লালমনিরহাটে থাকা মা বুলবুলি বেগমকে মোবাইলফোনে জানান ‘মা, তুমি ভাত খেয়ে ঘুমাও। আমি মসজিদে নামাজ পড়তে যাচ্ছি।’ এর কয়েক ঘণ্টা পর নয়নের বন্ধু ফোন দিয়ে তার মাকে জানায়, মসজিদে বিস্ফোরণে নয়ন দগ্ধ হয়েছেন। মা রাতেই লালমনিরহাট থেকে রওনা দিয়ে সন্তানের খোঁজে ঢাকায় আসেন। তবে সন্তানের দেখা পাননি। সন্তান শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটের আইসিইউতে ভর্তি। মা হাসপাতালের অভ্যর্থনা কক্ষে আহাজারি করছেন, ‘আমার নয়নকে একটু দেখাও।’

বিস্ফোরণের আগুনে দগ্ধ হয়ে মারা গেছে সাত বছরের শিশু জোবায়ের। হাসপাতালে মৃত্যুর সঙ্গে লড়ছেন তার বাবা জুলহাস মিয়া। শুক্রবার রাতে এশার নামাজ পড়তে যাওয়ার সময় মা রহিমা বেগম জোর করেই ছেলেকে বাবার সঙ্গে মসজিদে পাঠান। জোবায়ের শহরের তল্লা জেমস ক্লাব এলাকায় সবুজবাগ মডেল একাডেমির নার্সারির ছাত্র। মা ও বাবা দুইজনেই গার্মেন্টসে কাজ করায় সে গ্রামে বাড়ি বরিশাল সদর থানার রাঙ্গাবালিতে নানা-নানির কাছে ছিল। কিছু দিন আগে এসে স্কুলে ভর্তি হয়। এমনটাই বলছিলেন জোবায়েরের খালা তানজিলা বেগম। বলতে বলতে কান্নায় ভেঙে পড়েন তিনি।

পোশাক শ্রমিক মো. কেনান। গ্রামের বাড়ি পটুয়াখালীর রাঙ্গাবালী উপজেলায়। কেনানও শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটের আইসিইউতে ভর্তি। তার ছোট ভাই ইমরান বলেন, ‘আমার ভাই গার্মেন্টসে চাকরি করে। মসজিদে নামাজ পড়তে গিয়েছিল। বিস্ফোরণের খবর পেয়ে আমি বাসা থেকে দৌড়ে যাই। গিয়ে দেখি রাস্তার ওপরে সবাই ছটফট করতেছে। কেউ কেউ রাস্তায় জমে থাকা পানিতে গড়াগড়ি করছিল। সবাই দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখছিল। এরপর সবাই মিলে সবাইকে একে একে হাসপাতালে নেওয়া হয়।’

নারায়ণগঞ্জের ব্যবসায়ী ইব্রাহিম (৫০)। এশার নামাজ পড়তে তিনিও শুক্রবার রাতে মসজিদে যান। তার বড় ছেলে ফয়সালও মসজিদে ছিলেন। ছেলে নামাজ শেষ করে মসজিদ থেকে বের হয়ে ১০০ গজ দূরে যান। এর মধ্যে বিকট শব্দে বিস্ফোরণ হয়। হঠাত্ তার বাবার কথা মনে পড়ে। দৌড়ে মসজিদের সামনে যান।

ফয়সাল বলেন, ‘মসজিদের সামনে গিয়ে দেখলাম মানুষ বের হয়ে আসছে। এর মধ্যে দুই বার আগুনের গোলা বের হয়েছে। এরপর দেখি বাবাও রাস্তায় পড়ে আছে। দাড়ি, চুল, কাপড় সব পুড়ে গেছে, কিছু নেই। দ্রুত তাকে নারায়ণগঞ্জের ভিক্টোরিয়া হাসপাতালে নিয়ে যাই। সেখান থেকে ঢাকায় নিয়ে আসি।’

লাশ হয়ে বাড়ি ফিরলেন বাবা-ছেলে

নাঙ্গলকোট (কুমিল্লা) সংবাদদাতা জানান, নারায়ণগঞ্জে মসজিদে বিস্ফোরণে মারা গেছেন মসজিদের মুয়াজ্জিন কাম ইমাম হাফেজ মাওলানা দেলোয়ার হোসেন ভূঁইয়া (৪৭) ও তার বড় ছেলে অসুস্থ জোনায়েদ হোসেন (১৭)। গত শুক্রবার এশার নামাজের পূর্বে নিহত ইমাম স্ত্রী ফাহমিদা আক্তারকে ফোন করে জানান, তার এখানে ভালো লাগছে না। দুই-এক দিনের মধ্যে চাকরি ছেড়ে একেবারে বাড়ি চলে আসবেন। কিন্তু মাওলানা দেলোয়ার হোসেন ভূঁইয়া ছেলেসহ লাশ হয়ে গতকাল শনিবার রাতে বাড়ি এলেন। দেলোয়ার হোসেন নাঙ্গলকোটের ঢালুয়া ইউনিয়নের বদরপুর মধ্যপাড়ার মৃত হাফেজ মাওলানা শফিকুর রহমানের ছেলে। পিতা-পুত্রের মৃত্যুতে গ্রামের বাড়িতে এখন শোকের মাতম বইছে।

নিহত হাফেজ দেলোয়ার হোসেন ঐ মসজিদে প্রায় ২৫ বছর ধরে ইমামতির দায়িত্ব পালন করে আসছিলেন। ছেলে তার কাছে থাকলেও স্ত্রী তিন মেয়েকে নিয়ে গ্রামের বাড়িতে থাকেন। উপজেলা নির্বাহী অফিসার লামইয়া সাইফুল বলেন, এই পরিবারের প্রতি আমাদের সহমর্মিতা রয়েছে। আমরা সহযোগিতা করার চেষ্টা করবো।

কে জানতো এটাই জুবায়েরের শেষ নামাজ!

রাঙ্গাবালী (পটুয়াখালী) সংবাদদাতা জানান, বাবার সঙ্গে মসজিদে নামাজ পড়তে গিয়েছিল শিশু জুবায়ের। কিন্তু কে জানতো এটাই তার জীবনের শেষ নামাজ হবে! শুক্রবার বাইতুস সালাম মসজিদের বিস্ফোরণে জুবায়ের (৭) মারা যায়। অগ্নিদগ্ধ হয়ে গুরুতর আহত হয় তার বাবা সলেমান জুলহাস (২৮)। বর্তমানে তিনি শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ইউনিটে চিকিত্সাধীন। তার অবস্থা আশঙ্কাজনক ।

শনিবার বিকালে সরেজমিনে দেখা গেছে, পটুয়াখালীর রাঙ্গাবালী উপজেলার রাঙ্গাবালী ইউনিয়নের বাহেরচর বাজারে জুবায়েরের দাদা বাড়িতে কান্নার রোল চলছে। কান্নাজড়িত কণ্ঠে জুবায়েরের দাদি সালেহা বেগম বলেন, ‘আমার আদরের নাতি পৃথিবী ছেড়ে চলে গেছে। ছেলে মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়ছে। তার জন্য সবাই দোয়া করেন। আমার বুকের মানিকরে যেন আল্লাহ ফিরিয়ে দেয়।’ জুবায়েরের মা রাহিমা বেগম ফোনে জানান, জুবায়েরের লাশ তার কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। ঢাকা থেকে লাশ নিয়ে তিনি রাঙ্গাবালীর উদ্দেশ্যে রওনা দিয়েছেন।

জানা গেছে, ১০ বছর আগে অর্থনৈতিক সংকটের কারণে ঢাকায় পাড়ি জমান জুলহাস-রাহিমা দম্পতি। তারা দুই জনই নারায়ণগঞ্জে পোশাকশ্রমিক হিসেবে কাজ করতেন। শহরের পশ্চিম তল্লা এলাকায় থাকতেন। সেখানকার একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিশু শ্রেণিতে পড়তো জুবায়ের।

SHARE THIS ARTICLE