এ,কে,আজাদ – আইরিশ বাংলাপোষ্ট ডেস্কঃ ঈমানের পর নামাজই সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত। রাসুলুল্লাহ (সা.) নামাজকে মুসলিম ও অমুসলিমের মধ্যে পার্থক্যকারী আখ্যা দিয়ে বলেছেন, ‘মুমিন ব্যক্তি ও মুশরিক-কাফিরের মধ্যে পার্থক্য নামাজ ত্যাগ।’ (সহিহ মুসলিম, হাদিস : ৮২)
ইসলাম শুধু নামাজ আদায় নয়, বরং পরিবার ও সমাজে নামাজ প্রতিষ্ঠার নির্দেশও দিয়েছে। আল্লাহ বলেন, ‘আপনি আপনার পরিবারকে নামাজের নির্দেশ দিন এবং তার ওপর দৃঢ় থাকুন।’ (সুরা : ত্বহা, আয়াত : ১৩২)
সন্তানকে কেন নামাজে অভ্যস্ত করতে হবে
শৈশব থেকে সন্তানকে নামাজে অভ্যস্ত করে না তুলে ভবিষ্যতে সে নামাজের প্রতি যত্নবান হতে পারবে না। আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা.) বলেন, ‘তোমরা সন্তানদের নামাজের প্রতি যত্নবান হও এবং তাদের ভালো কাজে অভ্যস্ত করো। কেননা কল্যাণ লাভ অভ্যাসের ব্যাপার।’ (সুনানে বায়হাকি, হাদিস : ৫০৯৪)
এ ছাড়া শিশুর জীবনের গতিপথ নির্ধারণে পারিবারিক শিক্ষার গুরুত্ব অপরিসীম। ইমাম গাজালি (রহ.) বলেন, শিশু মা-বাবার কাছে আমানত এবং তার অন্তর মূল্যবান মণিমুক্তাতুল্য। তা শূন্য ক্যানভাসের মতো পবিত্র ও নির্মল। তা যে কোনো চিত্রের জন্যই উপযোগী এবং তাকে যে দিকে ইচ্ছা ফেরানো যায়। তাকে যদি ভালো কাজ শিক্ষা দেওয়া হয়, তবে সে দুনিয়া ও আখিরাতের সৌভাগ্যবান হবে। আর যদি তাকে মন্দ কাজে অভ্যস্ত করা হয় বা পশুর মতো অবজ্ঞা ও উপেক্ষা করা হয়, তবে সে হতভাগ্য ও ধ্বংস হবে। শিশুর রক্ষণাবেক্ষণ হলো তাকে আদব-কায়দা, শিষ্টাচার ও উন্নত চারিত্রিক গুণাবলি শিক্ষা দেওয়া। (ইউসুফ আল হাসান, আল ওয়াজিজ ফিত-তারবিয়্যাহ, পৃষ্ঠা-২)
নামাজে অভ্যস্ত করতে শরিয়তের নির্দেশনা:
সন্তান বালেগ হয়ে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে তাকে নামাজের নির্দেশ দিতে বলেছে ইসলাম। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘তোমরা তোমাদের সন্তানদের সাত বছর বয়সে নামাজের নির্দেশ দাও। তাদের বয়স ১০ বছর হওয়ার পর (প্রয়োজনে) নামাজের জন্য প্রহার করো এবং তাদের বিছানা পৃথক করে দাও।’ (সুনানে আবি দাউদ, হাদিস : ৪৯৫)
আবদুল্লাহ ইবনে ওমর (রা.) বলেন, সন্তান যখন ডান ও বাঁ পার্থক্য করতে শেখে, তখন তাকে নামাজ শেখাও। (মুসান্নাফে ইবনে আবি শায়বা, হাদিস : ৩৫০৪)
তবে এই দায়িত্ব পালনে জোরাজুরি নয়, বরং নামাজের জন্য তাদেরকে এমনভাবে উৎসাহ ও উদ্দীপনা দিতে হবে যাতে তারা নিজে থেকেই নামাজ আদায় করে নেয়।
আজকে শিশুদের নামাজে উৎসাহিত ও অভ্যস্ত করাতে সহায়ক ১৯ টি উপায় নিয়ে আলোচনা করা হলো।
১. নিজে নামাজে যত্নবান হওয়া : শিশুরা বড়দের দেখে শেখে। তাই সন্তানকে নামাজে অভ্যস্ত করার প্রথম শর্ত মা-বাবা ও অভিভাবক নিজেরা নামাজের প্রতি যত্নবান হওয়া। নতুবা শুধু উপদেশ খুব বেশি ফলপ্রসূ হবে না। আল্লাহ বলেন, ‘হে মুমিনরা! তোমরা যা করো না, তোমরা তা কেন বলো? তোমরা যা করো না তোমাদের তা বলা আল্লাহর কাছে অতিশয় অসন্তোষজনক।’ (সুরা : সফ, আয়াত : ২-৩)
শিশুরা তাদের পিতা-মাতার অনুকরণ করে। তাই তাদেরকে সঙ্গে নিয়েই আপনি ওজু ও নামাজ আদায় করুন। এতে করে তারা আপনাকে অনুকরণ করে নামাজ আদায়ে উৎসাহিত হবে।
শিশুর জন্য তার পিতা-মাতা প্রথম শিক্ষক। আপনাকে দেখেই আপনার শিশু বিভিন্ন শিক্ষা গ্রহণ করবে। যদি আপনি আপনার নিজের সকল কাজের চেয়ে নামাজকে গুরুত্ব দেন, আপনার শিশুও নামাজের গুরুত্ব সম্পর্কে সচেতন হয়ে বেড়ে উঠবে।
২. শৈশবেই ইবাদতের সূচনা: রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘সাত বছর বয়স হলেই তোমার শিশুকে নামাজ শিক্ষা দাও। দশ বছর বয়সে তারা নামাজ আদায় না করলে তাদেরকে শাসন করো এবং বিছানা আলাদা করে দাও।’ (আবু দাউদ, আহমাদ)
যদিও দশ বছর হওয়ার আগে শিশুদের নামাজ আদায়ের কোনো বাধ্যবাধকতা নেই, তথাপি তাদের শৈশবেই ঘরে এমন পরিবেশ সৃষ্টি করুন যাতে করে তারা নামাজ আদায়ে উৎসাহিত হয়।
৩. শিশুর নিজের জায়নামায: নামাজের জন্য উৎসাহিত করতে শিশুদেরকে নিজস্ব জায়নামায দিন। তাদের জায়নামায তাদেরকে নিয়মিত ব্যবহার করতে উৎসাহিত করুন।
৪. নামাযের দৃশ্যমান সময়সূচি: শিশুরা সর্বদাই দৃশ্যমান বস্তু ও তালিকায় প্রতিক্রিয়া করে। শিশুকে নামাজে উৎসাহিত করার জন্য নামাজের সময়সূচি সম্বলিত ঘড়ি, পঞ্জিকা ইত্যাদি ঘরে ঝুলিয়ে রাখুন। এসকল দৃশ্যমান সময়সূচি আপনার শিশুকে নামাজের জন্য উৎসাহিত করবে।
৫. নামাজ-পার্টি: মাঝে মাঝে আপনার শিশুকে তার সকল বন্ধু-বান্ধবসহ একসাঙ্গে নামাজ আদায়ের জন্য একত্রিত করুন। তাদেরকে নামাজেরর জন্য জায়নামায, টুপি, হিজাব, তসবিহ দিন। এরপর একসঙ্গে নামাজ আদায় করুন। নামাজ শেষে তাদেরকে চকলেট, ক্যান্ডি ইত্যাদি উপহার দিন এবং সম্ভব হলে নবী ও সাহাবীদের জীবনী হতে কিছু গল্প তাদের শোনান।
৬. আল্লাহ সম্পর্কে ধারণা প্রদান: আল্লাহর কথা জানানো ছাড়া শিশুকে নামাজ শেখানো খুব কার্যকরী নয়। শিশুকে আল্লাহর সম্পর্কে জানান এবং তাঁর অফুরান অনন্ত নেয়ামতের কিছু বিবরণ দিন। আল্লাহর এই নেয়ামতসমূহের শোকর আদায়ের জন্য নামাজ পড়ার গুরুত্ব সম্পর্কে তাদের শিক্ষা দিন।
৭. রাসূলুল্লাহ (সা.) সম্পর্কে শিক্ষা প্রদান: রাসূলুল্লাহ (সা.) এর জীবন সম্পর্কে আপনার শিশুকে শিক্ষা দিন। রাসূলুল্লাহ (সা.)-কে তার হিরোতে পরিণত করুন এবং তার প্রতি ভালোবাসার শিক্ষা দিন। রাসূলুল্লাহ (সা.) এর ভালোবাসা থেকেই তারা তাঁর অনুকরণে নামাজ আদায়ে উৎসাহিত হবে।
৮. ধীর পদক্ষেপ: শিশুকে নামাজ আদায়ের শিক্ষায় তাড়াহুড়া না করে ধীর পদক্ষেপে অগ্রসর হোন। কখনোই আশা করবেন না, আপনার শিশু একবারেই পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ আদায় করে ফেলবে।
৯. অভিভাবকের দৃঢ়তা: যদিও আমরা চাই আমাদের শিশুরা নিজে থেকে নামাজ আদায় করেই বড় হোক, তথাপি একসময় হয়তো তারা নামাজে অবহেলা করবে এবং নামাজ আদায় করতে চাইবে না।
পিতা-মাতা হিসেবে আমাদের দায়িত্ব তাদের নামাজ আদায়ে অভ্যস্ত করা। কখনই তাদেরকে নামাজ ছেড়ে দিতে না দেয়া। এক্ষেত্রে দৃঢ়তা বজায় রাখুন।
১০. পারিবারিক সময়দান: পারিবারিকভাবে মাঝে মাঝে একসঙ্গে নামাজ আদায় করুন। পিতার ইমামতিতে পরিবারের সকলকে নিয়ে নামাজের জামাত করুন। আপনার শিশু সক্ষম হলে তাকে আজান ও ইকামত দিতে দিন।
১১. জুমা ও ঈদের নামাজে আপনার শিশুকে নিয়েই নামাজ আদায় করুন। বিশাল জামাতে নামাজ আদায়ের দৃশ্য তাকে তার পরিচয় সম্পর্কে সচেতন ও নামাজে উৎসাহিত করবে।
১২. নামাজ পড়ার সময় সন্তানকে পাশে রাখা : মা-বাবা যখন নামাজ আদায় করবে সন্তানকে পাশে রাখবে। যেন সন্তান তার অনুকরণ করে। রাসুলুল্লাহ (সা.) নামাজের সময় হাসান ও হুসাইন (রা.)-কে সঙ্গে রাখতেন বলে হাদিসের বর্ণনায় পাওয়া যায়। কাতাদা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) তাঁর কন্যা জয়নব ও আবুল আসের কন্যা উমামাকে কোলে নিয়ে নামাজ আদায় করেছিলেন। যখন তিনি সিজদা দিতেন তাকে নামিয়ে রাখতেন এবং দাঁড়ালে তাকে কোলে নিতেন। (সহিহ বুখারি, হাদিস : ৫১৬)
১৩. বুঝমান সন্তানকে মসজিদে নেওয়া : রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর যুগে বালেগ ও অবুঝ উভয় ধরনের শিশুকে মসজিদে নেওয়ার বিবরণ পাওয়া যায়। আনাস (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) নামাজে এক শিশুর কান্না শুনলেন, যাকে তার মা নিয়ে এসেছিল; ফলে তিনি তার কিরাত ছোট করলেন বা ছোট সুরা পড়লেন। (সহিহ মুসলিম, হাদিস : ৪৭০)।
সুনানে নাসায়ির অপর বর্ণনায় পাওয়া যায়, হাসান ও হুসাইন (রা.)-কে দেখে রাসুলুল্লাহ (সা.) মিম্বার থেকে নেমে আসেন। (নাসায়ি, হাদিস : ৫০)
তবে ইসলামী আইনজ্ঞরা বলেন, শিশু বালেগ হওয়া বা তার বয়স সাত বছর হওয়ার আগে মসজিদে না নেওয়া উত্তম। কেননা এতে অভিভাবক ও অন্যান্য মুসল্লির নামাজে সমস্যা তৈরি হতে পারে।
১৪. হাতে-কলমে নামাজ শিক্ষা দেওয়া : সন্তান সাত বছর বয়সে উপনীত হলে তাকে হাতে-কলমে নামাজ শিক্ষা দেবে মা-বাবা। রাসুলুল্লাহ (সা.) সাহাবিদের হাতে-কলমে নামাজ শিক্ষা দিতেন। তিনি বলেন, ‘তোমরা আমাকে যেভাবে নামাজ আদায় করতে দেখো, সেভাবে নামাজ আদায় করো।’ (সহিহ বুখারি, হাদিস : ৬০০০৮)
১৫. নামাজের জন্য পুরস্কার দেওয়া : সন্তান যেন নামাজের প্রতি যত্নবান হয়; এ জন্য তাকে পুরস্কার দেওয়া যেতে পারে। ফজরের নামাজের জন্য উঠলে, মসজিদে নামাজের জামাতে হাজির হলে, নামাজের জন্য প্রয়োজনীয় দোয়া, তাসবিহ ও সুরা মুখস্থ করলে তাকে পুরস্কৃত করা যেতে পারে। এ ধরনের উৎসাহমূলক পুরস্কার প্রদানে ইসলাম উৎসাহিত করে। সম্প্রতি তুরস্কসহ বিভিন্ন দেশে এই পদ্ধতি অবলম্বন করে বেশ সাড়া পাওয়া গেছে।
১৬. নামাজের গুরুত্ব তুলে ধরা : সন্তানের সামনে নামাজের গুরুত্ব তুলে ধরা প্রয়োজন। ইসলামী শরিয়তে নামাজের গুরুত্ব, নামাজ আদায়ের সুফল, নামাজ না পড়ার কুফল, শাস্তি ইত্যাদি বর্ণনা করা যেতে পারে। যেমন—রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘অন্ধকারে মসজিদে গমনকারীর জন্য কিয়ামতের দিন পূর্ণাঙ্গ আলো লাভের সুসংবাদ দাও।’ (সুনানে আবি দাউদ, হাদিস : ৫৬১)
১৭. নামাজ সম্পর্কিত ঘটনা শোনানো : নামাজ কিভাবে ফরজ হলো, রাসুলুল্লাহ (সা.) নামাজের প্রতি কতটা যত্নবান ছিলেন, সাহাবিরা যুদ্ধের ময়দানেও কিভাবে নামাজ আদায় করেছিলেন এবং বুজুর্গ আলেমরা নামাজের মাধ্যমে কিভাবে জীবনের বিভিন্ন সংকট মোকাবেলা করেছেন—সেসব ঘটনা শিশুদের শোনালে তারা নামাজে উৎসাহী হবে।
১৮. নামাজের জন্য জবাবদিহি : সন্তান ঠিকমতো নামাজ পড়ছে কি না সেদিকেও মা-বাবাকে লক্ষ রাখতে হবে এবং নামাজে অলসতা করলে জবাবদিহির আওতায় আনতে হবে। আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, ‘আমি আমার খালা মায়মুনার কাছে রাতে অবস্থান করছিলাম। সন্ধ্যার পর রাসুলুল্লাহ (সা.) এসে জিজ্ঞেস করলেন, এই শিশু কি নামাজ পড়েছে? আমি বললাম, হ্যাঁ।’ (সুনানে আবি দাউদ, হাদিস : ১৩৫৬)
১৯. নামাজি হওয়ার জন্য দোয়া করা : সন্তান যেন নামাজের প্রতি যত্নবান হয়—এ জন্য মা-বাবা দোয়া করবে। কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘হে আমার প্রতিপালক! আমাকে নামাজ কায়েমকারী করুন এবং আমার বংশধরদের মধ্যে থেকেও। হে আমার প্রতিপালক! আমার প্রার্থনা কবুল করুন।’ (সুরা : ইবরাহিম, আয়াত : ৪০)
সন্তানকে নামাজে অভ্যস্ত করার পুরস্কার:
যারা সন্তানকে নামাজের নির্দেশ দেবে এবং তাদের নামাজে অভ্যস্ত করার চেষ্টা করবে, তাদের জন্য সবচেয়ে বড় পুরস্কার আল্লাহর সন্তুষ্টি। আল্লাহ তাআলা কোরআনে ইসমাইল (আ.)-এর প্রশংসা করে বলেছেন, ‘সে তার পরিবারকে নামাজ ও জাকাতের নির্দেশ দিত এবং সে ছিল আল্লাহর সন্তোষভাজন বান্দা।’ (সুরা : মারিয়াম, আয়াত : ৫৫)
এই আয়াতের ব্যাখ্যায় আল্লামা ইবনে কাসির (রা.) বলেন, ‘আল্লাহর আনুগত্যে অবিচলতা ও পরিবারকে তার নির্দেশ দেওয়ার কারণেই আল্লাহ এই উচ্চতর প্রশংসা করেছেন।’
মহান রাব্বুল আলামিন আল্লাহ তায়ালা শিশুদেরকে সঠিকভাবে নামাজের শিক্ষা গ্রহণ করার তাওফিক দান করুন। আল্লাহুম্মা আমিন।