আজকাল প্রতিনিয়ত বাংলিশ ভাষার প্রচলন বাড়ছে


এ,কে,আজাদ- আইরিশ বাংলাপোষ্ট ডেস্কঃ

মোদের গরব, মোদের আশা, আ মরি বাংলা ভাষা!
তোমার কোলে, তোমার বোলে, কতই শান্তি ভালবাসা!
কি যাদু বাংলা গানে!- গান গেয়ে দাঁড় মাঝি টানে,
এমন কোথা আর আছে গো!
গেয়ে গান নাচে বাউল, গান গেয়ে ধান কাটে চাষা।।

অতুলপ্রসাদ সেনের লেখা ও সুরে এ গানটিতে বাংলা ভাষার প্রতি বাঙালি জাতির গভীর মমত্ববোধ ও ভালোবাসা প্রকাশ পেয়েছে। যুগ যুগ ধরে এ গান শুধু বাঙালি গেয়েই আসছে; তবে বাংলা ভাষাকে আমরা অন্তরে সত্যিই কি জায়গা দিতে পেরেছি? পেরেছি কি ভাষার যথাযথ মর্যাদা ও সম্মান অক্ষুন্ন রাখতে?
মাতৃভাষার অধিকার ও মর্যাদা স্থাপনে একটি জাতির প্রচেষ্টা এবং আত্মোৎসর্গ দুনিয়ার অন্য কোন জাতির ইতিহাসে নাই। বাংলাভাষার গৌরবময় সংগ্রামের ইতিহাস বিশ্ববাসীর নিকট চিরস্মরণীয় করে রাখার জন্য কানাডা প্রবাসী রফিকুল ইসলাম ও আবদুস সালাম প্রথম চিন্তা করেন। তারা বিশ্বের মাতৃভাষাপ্রেমী সংস্থার মাধ্যমে জাতিসংঘের নিকট ২১ ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে পালন করার প্রস্তাব উপস্থাপনের উদ্যোগ নেন। প্রস্তাবটি পেয়ে জাতিসংঘ কর্তৃপক্ষ জানায় এটি বাংলাদেশ সরকার দ্বারা আনুষ্ঠানিকভাবে প্রস্তাবিত হতে হবে।
জাতিসংঘের শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতি প্রতিষ্ঠান (ইউনেস্কো) ১৯৯৯ সালের ১৫ নবেম্বর প্যারিসে তার ৩০তম সাধারণ সভায় ২১ ফেব্রুয়ারিকে সর্বসম্মতিক্রমে মাতৃভাষা দিবস হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। তারপর থেকে পৃথিবীর ১৮৮টি দেশের ৬০০ কোটিরও অধিক মানুষ প্রতিবছর ২১ ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস পালন করছে। ইউনেস্কো কর্তৃক এই স্বীকৃতি বাংলা ভাষা আন্দোলনকে ও তার উৎস-প্রতীক ২১ ফেব্রুয়ারিকে বিশ্বজনতার বাক, বিবেক, লেখা, প্রকাশনের অলঙ্ঘনীয় অধিকারের স্মারক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে। সেদিন ২১ ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে ইউনেস্কো বলেছিল : ‘মাতৃভাষা প্রচলন ও বিকাশের সকল প্রচেষ্টা কেবল ভাষাগত বৈচিত্র্য ও বহুভাষী শিক্ষাকে উৎসাহিত করবে না, তাদের বিশ্বব্যাপী বিকাশেও ভূমিকা পালন করবে এবং সংলাপ, সমঝোতা ও সহনশীলতার ভিত্তিতে সংহতিকে উৎসাহিত করবে।’আমাদের মাতৃভাষার মর্যাদার দাবি, স্বাধিকার সংগ্রাম ও আর্থ-সামাজিক অর্জনের ভিত্তি মহান একুশ।

সভ্যতা ও সংস্কৃতি বিকাশে, তথ্যপ্রযুক্তির ব্যাপক অগ্রগতির সঙ্গে তাল মিলিয়ে ক্রমাগত কমেছে সঠিক উচ্চারণে বাংলা ভাষার ব্যবহার। বেড়েছে বিদেশি শব্দের ব্যবহার। আজকাল নিম্নবিত্ত থেকে মধ্যবিত্ত, মূর্খ থেকে সমাজের উচ্চশিক্ষিত সবাই চায় কথার মাঝখানে দু-একটু ইংরেজি বলতে। অথচ কেউ চায় না শুদ্ধ করে বাংলা বলতে।

বাংলা আর ইংরেজির সংমিশ্রণে আজকাল প্রতিনিয়ত বাংলিশ ভাষার প্রচলন বাড়ছে। ফলে বাংলা ভাষা হারাচ্ছে স্বকীয়তা। সকালে ঘুম থেকে ওঠা থেকে রাতে ঘুমাতে যাওয়ার আগ মুহূর্ত পর্যন্ত প্রতিনিয়ত আমরা বাংলা ভাষার অপব্যবহার করছি। এর কিছুটা আমরা জেনেশুনে করছি, কিছুটা আবার অজান্তেই।

রেডিও, টেলিভিশনে আজকাল প্রায়ই আধুনিকতার নামে বাংলাকে ভিন্নভাবে উপস্থাপন করা হচ্ছে। তারকাদের কথার মাঝখানে শুধু বাংলা খোঁজা যেন আজকাল অমাবস্যার চাঁদের ন্যায়।

রেডিওর জকিদের বাংলা ভাষার উচ্চারণ ভঙ্গি, বিদেশি ভাষার সংমিশ্রণে প্রতিনিয়ত অব্যবহার হচ্ছে সালাম, বরকত, রফিক, শফিউর, জব্বারসহ অসংখ্য শহীদের প্রাণের বিনিময়ে অর্জিত বাংলা ভাষা।

ভাষা আন্দোলনের ৬৯ বছর পার করেছি অথচ এখনও কোথাও বাংলা ভাষার প্রকৃত মর্যাদা নেই। বাংলা ভাষা আজ বিপদগ্রস্ত।

বাংলা ভাষাকে প্রাপ্য মর্যাদা দিতে আমরা কার্পণ্য করছি। অফিস-আদালত, সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান কিংবা আমাদের নিত্যদিনের কার্যক্রমে আমরা বাংলার চেয়ে ইংরেজিকেই বেশি প্রাধান্য দিচ্ছি। এতে করে বাংলা হারাচ্ছে তার স্বকীয়তা, হারাচ্ছে তার অস্তিত্ব।

আমরা বিদেশি ভাষার বিরোধী নই, আধুনিক শিক্ষা ব্যবস্থায় বিশ্বায়নের এ যুগে বিদেশি ভাষার অবশ্যই প্রয়োজন আছে; তবে তা নিজ মাতৃভাষার চেয়ে বেশি নয়।

যে মাতৃভাষায় পারদর্শী নয়, সে ভিনদেশি কোনো ভাষাও পারদর্শী হবে না। বাংলা ভাষার প্রতি যে আমাদের বাঙালিদের একটা ভালোবাসা আবেগ জড়িয়ে আছে, সেটা যেন শুধু দিবসকেন্দ্রিক না হয়। শুধু ২১ ফেব্রুয়ারি বা আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস এলেই শুধু আমরা বাংলার প্রতি মমত্ববোধ দেখাব না। আমাদের এ মমত্ববোধ যেন বছরজুড়েই থাকে।

আজকাল আধুনিকতার নামে বিদেশি ভাষার প্রতি বেশি গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে। চারদিকে একটা অসুস্থ প্রতিযোগিতা দেখা যাচ্ছে। শিক্ষার্থীরা ভালো চাকরি পাওয়া কিংবা বিদেশে উচ্চশিক্ষা লাভের আশায় বিদেশি ভাষার প্রতি গুরুত্ব দিচ্ছে বেশি। এ থেকে আমাদের বেরিয়ে আসতে হবে। জাপান, চীন, জার্মানি, ফ্রান্স প্রভৃতি উন্নত দেশের নাগরিকরা নিজ ভাষা ও সংস্কৃতির প্রতি অত্যন্ত যত্নশীল।

আমাদের দেশে এমএফ রেডিওতে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে বাংলা ভাষাকে বিভিন্ন বিকৃত উচ্চারণে উপস্থাপন করা হচ্ছে। কথা বলছে বাংলায় কিন্তু তাদের উচ্চারণ ভঙ্গি থাকে ইংরেজি ভাষার ন্যায়। এটি নাকি স্মার্টনেস! মনে রাখতে হবে শুদ্ধভাবে প্রমিত উচ্চারণেরও আধুনিকতা দেখানো যায়। নিজেকে উপস্থাপন করতে চাইলে তা মাতৃভাষায়ও সুন্দরভাবে উপস্থাপন করা যায়।
ভাষা মানুষের বিচ্ছিন্নতা দূর করে, পরস্পরকে ঐক্যবদ্ধ করে। ভাষা শ্রেণী মানে না, ধর্ম মানে না, আঞ্চলিক বিভেদকে অগ্রাহ্য করে। কাজেই দেশ ও জাতির ঐতিহাসিক প্রয়োজনে বাংলাভাষা চর্চাকে বিকশিত ও উন্নত করাই হবে আমাদের অন্যতম কর্তব্য।

SHARE THIS ARTICLE