ইসরায়েলের কোভিড পরিস্থিতি থেকে আমাদের শিক্ষা কি?

ডাঃ জিন্নুরাইন জায়গীরদারঃ কোভিড-১৯ মহামারি সময়ে টিকা প্রদানের ক্ষেত্রে এক সময়ে সবচেয়ে এগিয়ে থাকা দেশ ইসরায়েল এখন বিশ্বে মহামারির অন্যতম হটস্পট। এক সময় আমাদের মনে হয়েছিলো যে বিশ্বের সকল দেশের আগে ইসরায়েল তাদের দেশের পুরো জনসংখ্যাকেই টিকা প্রদান সম্পন্ন করবে। কিন্তু আজ পরিস্থিতি ভিন্ন, এক পর্য্যায়ে এসে তাদের টিকা প্রদান স্থবির হয়ে যায়। এই স্থবিরতার অন্যতম কারণ হচ্ছে জনগণের কয়েকটি অংশের মধ্যে টিকা গ্রহণে অনীহা দেখা দেয়। এদের মধ্যে একটি অংশ ছিলেন গোঁড়া ইহুদি আর ছিলেন কিছু আরব। এছাড়াও দেশটি বিশ্বের অন্যান্য দেশের মত তখন শিশুদের টিকা প্রদানের আওতায় আনেনি।সকল কিছু খুলে দেয়া হয় এমনকি স্কুল কলেজ খুলে দেয়া হয়। ইতিমধ্যে দেশটিতে ডেল্টা ভাইরাস প্রবেশ করে এবং সংক্রমণ বাড়তে থাকে।

This image has an empty alt attribute; its file name is image-2.png


টিকা প্রদানের ক্ষেত্রে গত এপ্রিল মাসে, ব্লুমবার্গের ভ্যাকসিন ট্র্যাকারে ইসরায়েল বিশ্বের প্রথম অবস্থানে ছিল এখন সেই অবস্থান থেকে নেমে এসেছে ৩৩তম অবস্থানে। প্রায় ৬৩% ইসরায়েলের মানুষকে টিকার দুটি ডোজ দেয়া হয়েছে। জন হপকিন্স বিশ্ববিদ্যালয়ের ৪ঠা সেপ্টেম্বরের সংকলিত পরিসংখ্যান অনুসারে,  উক্ত সপ্তাহে বিশ্বের অন্য যে কোনও দেশের চেয়ে ইসরায়েলে মাথাপিছু কেস লোড (সংক্রমিতের হার) ছিল সবচেয়ে বেশী। দেশটি ইতিমধ্যে বিশ্বজুড়ে টিকা প্রদানের হারে, লিগ টেবিলের অনেক নিচে নেমে গেছে। এই মুহুর্তে দেশটির টিকা প্রদানের ক্ষেত্রে তাদের অবস্থান ইউরোপের অধিকাংশ দেশের চেয়ে নিম্নে।

আপনাদের অনেকেরই হয়তো মনে আছে, গত এপ্রিল মাসে যখন ইউরোপ এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বেশিরভাগ অংশে কোনও না কোন ধরনের লকডাউনের আওতায় ছিল এবং টিকা প্রদানের ক্ষেত্রে অনেক অনেক পিছিয়ে ছিল, তখন ৯০ লক্ষ জন অধ্যুষিত এই দেশটি লক ডাউন খুলে দিয়ে অর্থনীতি সচল করার ক্ষেত্রে বিশ্বে মাইলফলক হয়ে গিয়েছিলো। সবচেয়ে অগ্রগামী সেই ইসরায়েলের পরিসংখ্যান এখন সম্পুর্ন বদলে গিয়েছে। দেশের মানুষ এখন করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হচ্ছে কি হচ্ছেনা না তা নিয়ে ভাবছে না বরং তারা ভাবছে আক্রান্ত হলে কতটুকু অসুস্থ হতে পারে আর টিকা আদৌ কাজ করছে কিনা কেননা ডেল্টা ধরনের ভাইরাসের ক্ষেত্রে টিকার প্রতিরোধ ক্ষমতা হ্রাসের সম্ভাবনা ইতোমধ্যে প্রদর্শিত হয়েছে।

সাম্প্রতিককালে, যখন শিশুদের টিকা প্রদানের ব্যাপারে এবং দুই ডোজ টিকা প্রদানের পর ধীরে ধীরে টিকার কার্য্যকরিতা হ্রাসের ব্যাপারে গবেষণার ফলাফল আসতে শুরু করেছে, তখন তারা আবার অগ্রগামী হয়ে শিশুদের টিকা দিতে শুরু করেছে এবং টিকার তৃতীয় বুস্টার ডোজ দেবার কাজেও অগ্রবর্তি ভূমিকা রেখেছে। এই মুহূর্তে প্রতিদিন তারা ফাইজার বায়োনটেকের প্রায় এক লক্ষ ডোজ টিকা প্রদান করছে যার অধিকাংশই বুস্টার ডোজ।

এই গ্রীষ্মে যখন ডেল্টা সংক্রমণ বিস্তার লাভ করলো তখন ইসরায়েলে সংক্রমণ বেড়ে গত ২রা সেপ্টেম্বর একদিনে দেশটির ইতিহাসে সর্বোচ্চ শিখর ১১,৩১৬ জনে এসে দাঁড়িয়েছিল। গুরুতর অসুস্থ এবং হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার সংখ্যা প্রথম তরঙ্গের হারে না বেড়ে আগস্টের শেষ দিকে ৭৫১তে এসে পৌঁছেছিল, জানুয়ারির মাঝামাঝি সময়ে এই সংখ্যা ছিল ১১৮৩। হাসপাতালে ভর্তির প্রবণতা এখন নিম্নমুখী।

যারা টিকা গ্রহণ করেন নি তারা এবং শিশুরা আক্রান্ত হওয়ার কারণে মূলত এই সংক্রমণ বাড়ছে, তবে বেশ কিছু মানুষ সংক্রমিত হয়েছেন যারা ইতিমধ্যে দুই ডোজ টিকা গ্রহণ করেছেন এবং এর কারণ হিসেবে টিকার কার্য্যকরিতা হ্রাস বলেই মনে করা হচ্ছে। প্রতিবেদনে দেখা যায়, যে সকল মানুষ টিকা গ্রহণ করেন নি তাদের সংক্রমণের সংখ্যা টিকা গ্রহণকারীদের থেকে ১০ গুনের বেশী। সেই হিসেবে, ডেল্টা ধরনে টিকার কার্য্যকারিতা কম হলেও অধিকাংশ মানুষকে এই টিকা সুরক্ষা প্রদান করছে বলেই প্রমাণ মিলছে।

এই মুহূর্তে ইসরায়েলে শিশুদের মধ্যে সংক্রমণ বাড়ছে কেননা স্কুল খুলে দেয়া হয়েছে। ৩০ বছরের নীচে যাদের বয়স তাদের সংক্রমণের হার ইতিমধ্যে বেশ কমেছে। দেশটি এখন দ্রুত বুস্টার টিকা দিচ্ছে, রেস্টুরেন্ট আর বার বন্ধ করে দেয়া হয়েছে, যার কারণে সংক্রমণে নিম্নগতি লক্ষ্য করা যাচ্ছে। ইসরায়েল ইতিমধ্যে ২৬ লক্ষ (২৮%)মানুষকে বুস্টার টিকা প্রদান করেছে। যারা ৫ মাস আগে ২য় ডোজ টিকা নিয়েছেন তাদের সবার জন্যই তৃতীয় ডোজ অর্থাৎ বুস্টার ডোজ দেবার প্রস্তুতি নিয়েছে ইসরায়েল।

গতকালের সর্বশেষ পরিসংখ্যানে দেখা যাচ্ছে, সংক্রমণ কমে এসেছে অনেকখানি। আর নাম্বার গত ৩মাসের মধ্যে সর্বনিম্ন (০.৯৫%) হয়েছে। এদিকে গতকাল বেশী অসুস্থ অবস্থায় হাসপাতালে ছিলেন ৬৬২ জন, এরমধ্যে ৬৯ জন নূতন অসুস্থ হয়েছেন। এই ৬৯ জন্মের মধ্যে ৪৯ জন টিকা গ্রহণ করেন নি আর ২৯ জনের বয়স ৬০ বছরের নীচে।

 
অনেকেই মনে করছেন, ইসরায়েলের মত দেশ আমাদের সকলের জন্য কিছু শিক্ষা নিয়ে এসেছে। প্রথম শিক্ষা হচ্ছে, টিকা গ্রহণ ও প্রদানে শতভাগ সফলতার লক্ষ্যে কাজ করে যাওয়া আবশ্যিক। হার্ড ইমিউনিটির ব্যাপারটি এখন স্বপ্নের মত হয়ে গেছে বিশেষ করে ভাইরাস মিউটশনের কারণে।  টিকা গ্রহণের কারণে সংক্রমণের হার কমেছে, মারাত্নক অসুস্থ হওয়ার সম্ভাবনা কমেছে আর মৃত্যুর সম্ভাবনা তাৎপর্য্যপূর্নভাবে কমেছে। তবে দ্বিতীয় ডোজ দেবার ৫/৬ মাসের মাথায় টিকার কার্য্যকারিতা অনেকখানি কমেছে বিশেষ করে নূতন রূপ ডেল্টার সংক্রমণের কারণে। তাই লকডাউন ছাড়া জীবন পরিচালনা এবং অর্থনৈতিক কার্য্যক্রম পরিচালনার লক্ষ্যে তৃতীয় (বুস্টার) ডোজ গ্রহণ অতিরিক্ত সুরক্ষা দেবে বলেই অনুমিত হচ্ছে। শিশুদের টিকা প্রদানের ব্যাবস্থা দ্রুত সম্পন্ন করার কথা ভাবতে হবে। আমাদের জীবন কার্য্যক্রম পরিচালনায় পরিবর্তন এনেই বিশ্বকে পরিচালনা করা ছাড়া আর কোন গত্যন্তর এই মুহূর্তে দেখা যাচ্ছেনা। ভাবতে হবে, যেখানে বিশ্বের অনেক মানুষ এখনো টিকার একটি ডোজ পায়নি সেখানে উন্নত দেশ তৃতীয় ডোজ নিতে শুরু করেছে। এরপর কি প্রতি ৬ মাস অন্তর বুস্টার নিতে হবে? সারা বিশ্বকে টিকার আওতায় দ্রুত কিভাবে আনা যায়? এই প্রশ্নগুলো থেকেই যাচ্ছে। বিজ্ঞানীদের কি একটি সার্বজনীন টিকা নিয়ে কাজ শুরু করা উচিত হবে না? ভাইরাস বিরোধী আরও শক্তিশালী ঔষধ কি আমরা আবিষ্কার করতে পারিনা? আবার যদি ডেলটা থেকে ভয়াবহ আর কোন ধরনের কোভিড জন্ম নেয় তাহলে আবার লক ডাউনে যাওয়ার বিকল্প পন্থা এখন থেকে ভেবে রাখা প্রয়োজন।

তথ্যসূত্রঃ ব্লুমবার্গ, জন হপকিন্স, বিবিসি, হারেটয, ওয়ার্ল্ড ইন ডাটা

SHARE THIS ARTICLE