পবিত্র ঈদ-উল আযহার শুভেচ্ছা

ডাঃ জিন্নুরাইন জায়গীরদার: আজ শুক্রবার ৩১শে জুলাই থেকে ২রা আগস্ট পর্য্যন্ত আমরা সবাই ঈদুল আযহা উদযাপন করতে যাচ্ছি। যদিও সময়ের ব্যাবধানের কারণে কিছু কিছু দেশে আগামীকাল থেকে ঈদুল আযহা পালিত হবে। সেই একই কারণে বাংলাদেশে আগামীকাল থেকে ঈদ উদযাপিত হবে। সকলকে ঈদ মোবারক, ঈদের শুভেচ্ছা। আমাদের ইচ্ছা, আকাংখা, আমাদের প্রার্থনা এবারের ঈদুল আযহা আমাদের হৃদয়ে নির্মলতা, আমাদের দেশে মঙ্গল, আমাদের বিশ্বে শান্তি বয়ে আনুক। এই ঈদ আমাদের জন্য আনন্দের হোক, সুখের হোক, শুভ বার্তা বাহক হোক। আমরা সেই মহান আল্লাহর প্রশংসা করি, যিনি আমাদেরকে আরেকটি ঈদুল আযহা পালনের সুযোগ দিয়েছেন। আমরা কায়মনোবাক্যে প্রার্থনা করছি যাতে এই পবিত্র দিনগুলি আমাদের জাতি, মুসলিম বিশ্ব এবং সমগ্র মানব জাতির জন্য শুভ পরিণতির বার্তাবাহক হয়। � মুসলিম বিশ্বের জন্য এবারের হজ্ব অনন্যসাধারণ আবেশে অনুষ্ঠিত হচ্ছে। গতকাল ছিল আরাফাতের দিন। প্রতিবার যেখানে ২৫-৩০ লক্ষ মুসলিম উচ্চকিত কণ্ঠে “হে আল্লাহ আমি উপস্থিত হে আল্লাহ আমি উপস্থিত” এই উচ্চারণে আরাফাতের ময়দানে ক্ষমা, প্রগতি ও শান্তি কামনা করে থাকে সেখানে এবছর ১০ হাজার আভ্যন্তরীণ মুসলিম নিয়ে অত্যন্ত সীমিত পরিসরে হজ্বের সকল অনুষ্ঠানাদি সম্পন্ন হচ্ছে, সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে। আজ মিনাতে কোরবানির পর শয়তানের উদ্দেশ্যে পাথর নিক্ষেপের পর হজ্ব যাত্রীরা মক্কায় যাবেন তাওয়াফ করার লক্ষ্যে। আল্লাহ এই হজ্বকে সফল, কবুল ও মকবুল করুন। আমিন। � আল্লাহর হুকুমে মুসলিম জাতির পিতা ইব্রাহিম (আঃ সাঃ) তাঁর স্নেহের পুত্র ইসমাইল (আঃ সাঃ) কে বিসর্জনের সদিচ্ছার চিহ্ন হিসাবে প্রতিবছর আর্থিকভাবে সক্ষম মুসলিমরা ঈদের দিনে উট, গরু, ভেড়া এবং ছাগলের মতো প্রাণী কোরবানি করে থাকেন। কোরবানির মাংস বন্ধুবান্ধব, আত্নীয়স্বজন, দরিদ্র, ধনী সকলের মধ্যে বণ্টন করা হয় কিংবা সকলে মিলে আহার করা হয়। এই সময়ে আমরা বন্ধুবান্ধব, আত্নীয়স্বজন, পরিচিত, অপরিচিত, ধনী, দরিদ্র সকলের সাথে বিভিন্ন ভাবে মিলিত হই, কুশল বিনিময় করি, কোলাকোলি করি। এক ঘর থেকে আরেক ঘরে দল বেধে যাওয়াটা আনন্দের, আবেগের এবং সামাজিক সাম্যের বার্তাবাহক। মানুষের জীবনটা সুখ, আনন্দ, দুঃখ আর বেদনার সমষ্ঠি। আপনাদের মনে আছে, ২০২০ সালের ঈদুল ফিতর আমরা সকলেই ঘরে বন্দী থেকে উদযাপন করেছি। অনন্যসাধারণ ঐ ঈদের পর এসেছে ঈদুল আযহা। দূর্ভাগ্যক্রমে এই ঈদও আমরা শোকের সাথে পালন করতে যাচ্ছি। শোকের মধ্যে থেকেও কিভাবে আনন্দ উপভোগ করা যায় তার একটা প্রশিক্ষণ হবে এবারের ঈদ। যে মুহূর্তে আমি এই লিখা লিখছি সেই মুহূর্তের হিসাব অনুযায়ী সারা বিশ্বে ১ কোটি ৭৩ লক্ষেরও বেশী মানুষ কৈভিড-১৯ মহামারীতে আক্রান্ত হয়েছেন আর ৬ লক্ষ ৭৩ হাজারের ও বেশী মানুষ এই রোগে মৃত্যুবরন করেছেন, ওয়ার্ল্ডোমিটারের তথ্য অনুযায়ী। প্রকৃত সংখ্যা যে এর চেয়ে অনেক বেশী সে সম্পর্কে আমরা সকলেই অবগত আছি। � বিশ্বজুড়ে কোভিড-১৯ মহামারী এক ধরনের ত্রাস সৃষ্টি করেছে। কিছু দেশ কোভিড-১৯ এর সংক্রমণ সফলতার সাথে নিয়ন্ত্রণ করতে সক্ষম হয়েছে। একটি তথ্য অনুযায়ী বিশ্বের ৩৭ টি দেশ ইতিমধ্যে মহামারী নিয়ন্ত্রণে আনতে সক্ষম হয়েছে। আয়ারল্যান্ডে এর মধ্যে অন্যতম। ৫০ লক্ষ জন-অধ্যুষিত এই দ্বীপরাষ্ট্রে এ পর্য্যন্ত মোট সংক্রমিতের সংখ্যা ২৫ হাজার ৪৯২ আর মোট মৃতের সংখ্যা ১৭৬৪। গতকালের পরিসংখ্যান অনুযায়ী বিগত ২৪ ঘণ্টায় নূতন শনাক্ত হয়েছে ৮৫ জন আর মৃত্যুবরণ করেছেন ১ জন। নূতন সংক্রমণের এই সংখ্যা ক্রমান্বয়ে পুনরায় বৃদ্ধি পাচ্ছে, যা মোটেও সুখপ্রদ নয়। এমতাবস্থায় আমাদের নিজেদের সুরক্ষার দায়িত্ব অপরিসীম । ওয়ার্ল্ড হেলথ অর্গানাইজেশন থেকে ঈদ উপলক্ষ্যে পরামর্শ হচ্ছে সঠিক সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা। আমাদের মনে রাখা কর্তব্য যে, অপরিহার্য্য নয় এমন ধরনের অধিক মানুষের সমাবেশ এমতাবস্থায় পরিত্যাজ্য। যদিও সরকার থেকে আইন করে দেয়া হয়েছে নিজেদের ঘরে ১০ জনের অধিক যেন আমরা মিলিত না হই। অত্যাবশ্যক নয় এমন যে কোন সমাবেশ, আন্তর্জাতিক ভ্রমণ পরিত্যাজ্য। অত্যাবশ্যক আভ্যন্তরীণ সমাবেশ কোন অবস্থায়ই যেন ৫০ জনের অধিক না হয়। অত্যাবশ্যক বহিরাংগনে সমাবেশ কোনভাবেই যেন ২ শত জনের অধিক না হয়। কোনভাবেই যেন আমরা সামাজিক দূরত্বের নির্দেশনা লঙ্ঘন না করি। শেষ কথা হচ্ছে নিজেদের সুরক্ষিত রাখার জন্য সম্ভব হলে অধিক মানুষের সমাগম বর্জন করাই কাম্য, বিশেষ করে যারা বয়স্ক এবং রোগাক্রান্ত। আল্লাহ আমাদের নিজেদের সুরক্ষার সচেতনতা দিন। ��আমাদের জন্মভূমি বাংলাদেশ, সেখানে কোভিড এর চিত্র ভয়াবহ। সরকারীভাবে সংক্রমণের সংখ্যা ২ লক্ষ ৩৪ হাজার ৮৮৯ মৃতের সংখ্যা ৩০৮৩। আমরা মোটামুটিভাবে অবহিত যে, বর্তমান সময়ে বাংলাদেশে স্বাস্থ্য ব্যাবস্থ্যা বিপর্য্যস্ত। চিকিৎসক মৃত্যুর সংখ্যা প্রায় ১ শত জনের মত। হাসপাতালে সঠিক চিকিৎসা পাওয়া আজ এক দুরাশার কথা। সরকার দেশটিকে খুলে দিয়েছেন, জোন ভিত্তিক কিছু কিছু লক ডাউন এখনো চলছে কিন্তু অব্যাবস্থাপনা আর সমন্বয়হীনতা আজ অন্য এক মহামারী। দুর্নীতি আর স্বজনপ্রীতির এক ভয়াবহ চিত্র প্রকাশিত। সরকারের প্রচেষ্টা অন্তহীন কিন্তু প্রচেষ্ঠাগুলো লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে ব্যার্থ। সর্বোপরি জনগণ হিসাবে আমাদের অসচেতনতা আমাদেরকে ঠেলে দিয়েছে এক কঠিন প্রান্তে। একটি আশার আলোকরেখা পরিলক্ষিত হচ্ছে, পরিসংখ্যান যাই বলুক না আর কারণ যাই হোক না কেন, কোভিড-১৯ এ মৃতের হার পৃথিবীর অন্যান্য অনেক দেশের তুলনায় অনেক কম। এদিকে ঈদ উপলক্ষ্যে কোরবানীর গরুর হাট কি সংবাদ নিয়ে আসে সেটা আমাদের জানা নেই। আমাদের আত্নিয়, স্বজন, বন্ধু, বান্ধব অনেকেই হারিয়ে গেছেন। আল্লাহ সকলকে বেহেশতে স্থান দিন এই আমাদের প্রার্থনা। আল্লাহ আমাদের দেশের জনগণকে সুরক্ষিত রাখুন। আমিন। � আপনারা অনেকেই অবগত আছেন, আয়ারল্যান্ড বাংলাদেশ কমিউনিটির দুজন সদস্যকে আমরা সম্প্রতি হারিয়ে ফেলেছি। এদের একজন কর্কের অধিবাসি জুয়েল মিয়া, মৃত্যুবরণ করেছেন মারনঘাতি ক্যান্সার রোগে আর টিউমের অধিবাসী আইনুল হক সম্ভবতঃ হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেছেন। আল্লাহ তাদের উভয়কে জান্নাতবাসী করুন আর তাদের পরিবারকে এই ব্যাথা বহন করার শক্তি প্রদান করুন। আরও বেদনার সংবাদ এই যে গতকাল ট্রালি নিবাসী মসিউল ইসলাম জাকিরের নবজাতক শিশু কন্যা সারাহ ইসলাম, জন্মগত ফুসফুসের সমস্যার কারনে জন্মের সাড়ে পাঁচ মাসের মাথায় গতকাল মৃত্যুবরণ করেছেন। আজ এই ঈদের দিনেই তাকে ট্রালিতে সমাহিত করা হচ্ছে। নবজাতক হিসাবে এই শিশুটি পাপমুক্ত, আল্লাহ তাকে শান্তিতে রাখুন আর এই পরিবারকে ধৈর্য ধারণের শক্তি প্রদান করুন। ��শোক আর বেদনা মিশ্রিত বৈশ্বিক মহামারীর এই সময়ে বিসর্জনের বাণী নিয়ে অনন্যসাধারণ ঈদ আজ আমরা পালন করতে যাচ্ছি, আসুন এই ঈদে আমরা সবাই সচেতনতার সাথে সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখি, অনাবশ্যক জনসমাবেশ পরিত্যাগ করি, জনসমাগম এড়িয়ে চলি। ঘরের বাইরে একে অপরের সাথে মিলিত হই, নূতন আলোকে আনন্দকে ভাগ করে নেই। এই মহান ঈদে আমাদের প্রার্থনা হোক, হে আল্লাহ আমাদেরকে বিপদমুক্ত করো, এমন একটি টিকা (ভ্যাক্সিন) আমাদের দান করো যার বদৌলতে এই বিপদ থেকে আমরা দ্রুত উত্তরণ ঘটাতে পারি। অকাল মৃত্যু থেকে আমাদের পরিত্রাণ দাও। শোকের আবহে আনন্দ করার শক্তি আমাদের দান করো। আগামী দিনগুলো আমাদের জন্য সুখের হোক, আনন্দের হোক, উজ্জ্বল দিনের আশায় তোমার পানে আমাদের সকল প্রার্থনা। আল্লাহ আমাদের সহায় হউন। আমিন।।

SHARE THIS ARTICLE