উত্তর আয়ারল্যান্ড কি পুনরায় অস্থিতিশীল হতে যাচ্ছে?

ডাঃ জিন্নুরাইন জায়গীরদারঃ উত্তর আয়ারল্যান্ডে গত কয়েকদিন থেকে দাঙ্গা হাঙ্গামা অব্যাহত আছে। গত শুক্রবার রাতেও তরুণরা পুলিশকে লক্ষ্য করে ইট পাটকেল, আতশবাজি এবং পেট্রোল বোমা নিক্ষেপ করেছে। এই সময়ে রাজ্যটির বিভিন্ন স্থানে গাড়ি হাইজ্যাক ও বাসে আগুন দেবার মত ঘটনাও ঘটেছে। পুলিশ দাঙ্গা নিরোধে রাবার বুলেট এবং জল কামান ব্যাবহার করেছে। 

শুক্রবার রাতে রাস্তাগুলি অপেক্ষাকৃত শান্ত ছিল, কেননা নেতারা রানী দ্বিতীয় এলিজাবেথের স্বামী প্রিন্স ফিলিপের মৃত্যুর পর সকলকে শান্ত থাকার আবেদন করেছিলেন। কিন্তু ছোট ছোট দলে বিভক্ত তরুণরা  বেলফাস্টে বিক্ষিপ্ত ভাবে পুলিশকে লক্ষ্য করে গুলি ছুঁড়ে একটি গাড়ি জ্বালিয়ে দেয়। শুক্রবার রাতে গোলযোগে ১৪ জনের মত পুলিশ সদস্য আহত হয়েছেন। গত কয়েকদিনে সর্বমোট ৮৮ জন পুলিশ আহত হওয়ার সংবাদ পাওয়া গিয়েছে। 

Resurgence of violence threatens to drag N Ireland back to past | Financial  Times

প্রজাতন্ত্রী আয়ারল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী মিহল মার্টিন উত্তর আয়ারল্যান্ডে, সাম্প্রদায়িক দ্বন্দ্বের অতীতে ফিরে যাওয়ার বিরুদ্ধে হুশিয়ারি উচ্চারণ করেছেন। মিহল মার্টিন গুড ফ্রাইডে চুক্তির ২৩তম বার্ষিকী উপলক্ষে একটি বিবৃতিতে বলেন: “চুক্তি যারা করেছে সেই প্রজন্ম এবং চুক্তি রক্ষাকারী ভবিষ্যৎ প্রজন্মের নিকট আমরা ঋণী, যারা অন্ধকার অতীতে ফিরে যেতে চায়না। বর্তমান নেতৃবৃন্দকে এগিয়ে আসতে হবে যাতে কোনভাবেই জাতি তার অতীতের দ্বন্দ্ব এবং সংঘাতের দিকে ফিরে যেতে না পারে।”

উত্তর আয়ারল্যান্ডের গত কয়েকদিনের বিশৃঙ্খলার দৃশ্যগুলি “ট্রাবলস” নামে পরিচিত কয়েক দশকের  ক্যাথলিক-প্রোটেস্ট্যান্ট সংঘাতের স্মৃতিকে আবার স্মরণ করিয়ে দেয়। ১৯৯৮ সালে “গুড ফ্রাইডে” নামের একটি শান্তি চুক্তি, সহিংসতার অবসান ঘটিয়ে একটি শান্তিপূর্ন পরিবেশ ফিরিয়ে দিয়েছিলো কিন্তু উত্তর আয়ারল্যানড সমাজের গভীরে উত্তেজনা কিংবা দ্বন্দ্বের শিকড়কে সমূলে উৎপাটিত করতে পারেনি। 

চলুন আমরা দেখি এই সহিংসতার পটভূমি কি?

ভৌগোলিকভাবে, পুরো আয়ারল্যান্ডে একটি দ্বীপ, যা কয়েকশত বছর ধরে ব্রিটিশ উপনিবেশ হিসেবে শাসিত হওয়ার পর প্রায় ১০০ বছর আগে এই শাসনের অবসান ঘটে। এই দ্বীপের ক্যাথলিক অধ্যুষিত ২৬টি কাউন্টিকে নিয়ে প্রজাতন্ত্রী আয়ারল্যান্ড নামে স্বাধীন রাষ্ট্র গঠিত হয় আর প্রোটেস্ট্যান্ট সংখ্যাগরিষ্ট অন্য ৬টি কাউন্টি যুক্তরাজ্যের অন্তর্গত হিসেবে থেকে যায়, যা বর্তমানে উত্তর আয়ারল্যান্ড নামে পরিচিত। 

প্রোটেস্ট্যান্ট অধ্যুষিত উত্তর আয়ারল্যান্ডে সংখ্যালঘু ক্যাথলিক সম্প্রদায় চাকরী, আবাসন এবং অন্যান্য ক্ষেত্রে বৈষম্যের শিকার হতে থাকে যার ফলে ১৯৬০ সালে একটি ক্যাথলিক নাগরিক অধিকার আন্দোলন গড়ে উঠে যারা পরিবর্তনের দাবি উত্থাপন করে, কিন্তু তারা সরকার এবং পুলিশ বাহিনীর পক্ষ থেকে কঠোর প্রতিক্রিয়ার মুখোমুখি হয়। ক্যাথলিক এবং প্রোটেস্ট্যান্ট উভয় পক্ষের কিছু লোক সশস্ত্র দল গঠন করে যারা বোমাবাজি ও গুলি চালিয়ে সহিংসতা বাড়িয়ে তুলে।

শান্তি বজায় রাখার প্রয়োজনে ১৯৬৯ সালে উত্তর আয়ারল্যান্ডে সেনাবাহিনী মোতায়েন করা হয়। আইরিশ রিপাবলিকান যারা দক্ষিণের সাথে ঐক্যবদ্ধ হতে চেয়েছিল তারা উত্তরাঞ্চলীয় আয়ারল্যান্ডকে যুক্তরাজ্যের সাথে সংযুক্ত রাখতে আগ্রহী “লয়ালিস্ট” এবং যুক্তরাজ্য সেনাবাহিনীর সাথে সহিংস দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়ে।

তিন দশক ধরে চলে সহিংসতা, এই দ্বন্দ্ব চলাকালীন সময়ে বোমা হামলা ও গোলাগুলিতে ৩,৬০০ জনেরও বেশি মানুষ মৃত্যুবরণ করেন যাদের বেশিরভাগই ছিলেন বেসামরিক মানুষ এবং উত্তর আয়ারল্যান্ডের অধিবাসী, যদিও আইরিশ রিপাবলিকান আর্মি লন্ডন এবং অন্যান্য ব্রিটিশ শহরগুলিতেও কিছু বোমা হামলা করেছিলো।

Northern Ireland: Why has violence broken out - and why now? | UK News |  Sky News

এবারে চলুন দেখা যাক কিভাবে এই সহিংসতা শেষ হয়?

১৯৯০ সালে শুরু হয় সমঝোতার লক্ষ্যে উভয় পক্ষের মধ্যে গোপন আলোচনা। প্রজাতন্ত্রী আয়ারল্যান্ড, যুক্তরাজ্য এবং আমেরিকার কূটনৈতিক প্রচেষ্টায় প্রতিদ্বন্দ্বী যোদ্ধারা একটি শান্তি চুক্তিতে পৌঁছাতে সক্ষম হন। ১৯৯৮ সালের এই গুড ফ্রাইডে চুক্তির ফলে যুদ্ধরত আধাসামরিক অস্ত্রধারীরা তাদের অস্ত্র জমা দিতে রাজি হয়। এই চুক্তির ফলে উত্তর আয়ারল্যান্ডে একটি ক্যাথলিক-প্রোটেস্ট্যান্ট যৌথ ক্ষমতা-ভাগাভাগির সরকার প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়। উত্তর আয়ারল্যান্ডের চূড়ান্ত স্থিতির প্রশ্নটি তখনকার মত পিছিয়ে দেয়া হয়; চুক্তি  করা হয় যে, যতদিন পর্য্যন্ত উত্তর আয়ারল্যান্ডের অধিকাংশ জনগণ না চাইবেন ততদিন পর্য্যন্ত এই অঞ্চল যুক্তরাজ্যের অন্তর্গত থাকবে; তবে ভবিষ্যতে উত্তর ও দক্ষিণ আয়ারল্যান্ড একত্রীকরণের লক্ষ্যে গণভোটের সম্ভাবনা বজায় থাকে। 

পরবর্তী সময়ে আইরিশ রিপাবলিকান আর্মির ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র গ্রুপ নিরাপত্তা বাহিনীর উপর কয়েকটি ক্ষুদ্র আক্রমণ করেছিলো এবং কিছু কিছু সাম্প্রদায়িক সহিংসতার ঘটনা ঘটলেও মুটামুটিভাবে দীর্ঘদিন থেকে উত্তর আয়ারল্যান্ডে শান্তি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে বলেই ধরে নেয়া যায়। ।

রাজনৈতিকভাবে, ক্ষমতা ভাগাভাগির সরকার প্রতিষ্ঠিত হলেও মাঝে মাঝে এই ব্যাবস্থার সাফল্য যেমন আমরা দেখেছি, একই সাথে এর ব্যর্থতাও আমরা প্রত্যক্ষ করেছি। বেলফাস্ট প্রশাসন ২০১৭ সালের জানুয়ারী মাসে গ্রিন এনার্জি প্রজেক্টের ব্যাপারে মতানৈক্যের কারণে ভেঙে পড়ে। আইরিশ ভাষার মর্যাদা সহ কিছু সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক বিষয়ে ব্রিটিশ ইউনিয়নিস্ট এবং আইরিশ ন্যাশনালিস্ট দলগুলির মধ্যে দ্বন্দ্বের কারণে দুই বছরের বেশী সময় ধরে উত্তর আয়ারল্যান্ডের সরকার গঠন স্থগিত ছিল। ২০২০ সালের শুরুতে পুনরায় সরকার গঠন হলেও প্রতিদ্বন্দ্বী দুটি গোষ্ঠীর অভ্যন্তরে গভীর মতভেদ ও অবিশ্বাস এখনো রয়ে গেছে। 

(আগামী পর্বে সমাপ্য)

SHARE THIS ARTICLE