জয়নাল হাজারীর নীরব প্রস্থান

হাসান সাঈদঃ ৮০র দশকে আমরা যখন ছাত্র ছিলাম তখন একটি শ্লোগান আমাকে খুব প্রভাবিত করতো , “তুমি বঙ্গবন্ধুকে ভালবাসো , আমরা তোমাকে ভালবাসবো…..” মুক্তিযুদ্ধের বহু আগ থেকেই আমাদের পরিবারটি বঙ্গবন্ধুর আদর্শের রাজনীতির সাথে জড়িত ছিল।

আমার নানা ৬ দফা আন্দোলনে যুক্ত ছিলেন। আমার দাদার দিকের আমার চাচা জ্যঠারা বা ফুফুরা সকলেই স্বাধীনতা আনদোলনের সংগঠক বা সমর্থক ছিলেন। ফলে আমাদের মধ্যেও একটি অসাম্প্রদায়িক মুক্তিযুদ্ধের চেতনা গ্রথিত হয়েছিলো বুদ্ধি হবার পর থেকেই। ৯০ দশকে আমাদের তরুন বয়সে জয়নাল হাজারী আমাদের আকৃষ্ঠ করেছিলেন বঙ্গবন্ধুকে প্রশ্নাতীত ভালবাসার ইমেজ ছড়িয়ে। দীর্ঘদেহী শস্রু মন্ডিত ভরাট কন্ঠের জয়নাল হাজারীর মানুষকে আকৃষ্ট করার চমৎকার ঐশ্বরিক গুণ ছিলো , যা দেখা যায় জাতীয় চার নেতার মাঝে আর জাতির জনকের মাঝে। ফেনীতে তখন যুবলীগের কোনো কর্মকাণ্ড ছিলনা।

May be an image of 1 person

জয়নাল হাজারী আমাদের ডেকে বললেন যুবলীগের একটি শক্তিশালী কমিটি তৈরী করতে। বাস হয়ে গেলো ….. এ্যডভোকেট জাহিদ হোসেন খসরু , এ্যডভোকেট ফরিদ হাজারী , এ্যডভোকেট ফারুক আলমগীর , এ্যডভোকেট জাকির হোসেন , বেন্টু হাজারী , আইনুল কবির শামিম আর আমি , আমরা ছুটলাম , দিন রাত গনসংযোগ প্রচারনা আর সম্মেলন করে দাঁড়া করালাম ফেনী যুবলীগ। খসরু ভাই সভপতি , বন্ধু বেন্টু হাজারী সাধারন সম্পাদক করে যুবলীগ জেলা কমিটি , এ্যডভোকেট জাকির সভাপতি আর আমি সাধারণ সম্পাদক পৌর কমিটি। পাড়ায় পাড়ায় উপজেলাগুলিতে , ইউনিয়নে চলল সম্মেলন আর কমিটি গঠন। পিছনে আছেন জয়নাল হাজারী …… নষ্টালজিক হয় যায় মন , চোখ ভিজে যায় সেসকল অমর রাজনৈতিক কাব্যের কথা মনে আসলে ……. গর্বিত হই , আমরাই প্রথম ফেনীতে যুবলীগ প্রতিষ্ঠা করেছিলাম জয়নাল হাজারীর নেতৃত্বে। অথচ আশ্চর্যজনকভাবে রাজনীতি ছাড়া জয়নাল হাজারীর মনে কখোনো ফেনীকে নিয়ে কোনো ভাবনা দেখিনি। তিনি ফেনীর একচ্ছত্র নেতা ছিলেন , বিএনপি ক্ষমতায় ছিল অথচ ফেনীতে তারা হাজারীর কারনে কোনঠাসা হয়ে থাকতো।

May be an image of 6 people, people standing and people sitting

তিনবার সংসদ সদস্য হয়েছিলেন। ফেনীকে তখন হাজারীর কারনে বাংলাদেশের বাইরেও মানুষ চিনতো। কিন্তু দুঃখের বিষয় এই যে , বছর বছর রাজাঝীর দীঘিতে বড়শি প্রতিযোগিতা , বৈশাখ মাসে পুবালী সংসদ আর মাস্টার পড়া লেডিস ক্লাবের উদ্যোগে বৈশাখী মেলা ছাড়া কোনো সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড হতোনা। কোনো উন্নয়ন মূলক কাজ কখোনো মানুষ দেখেনি তাঁর সময়ে। ফেনীর ট্রাংক রোড বা পাড়ার রাস্তাগুলো ভাঙাচোরা সরু চিপা আর ময়লা আবর্জনার ভরা থাকতো। রাস্তার বাতিও ঠিকমতো জ্বলতোনা। বহুকষ্টে কজন ডাক্তার মিলে ফেনীর মহিপালে একটি মেডিকেল কলেজ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন ( বিব্রত হবেন , একারনে নাম বলছিনা) , কলেজটি বেশ কবছর ভালো চলেছিলো , আমার কিছু ছাত্র সেখানে ভর্তিও হয়েছিল।

কিন্তু হাজারীকে সেখানে গভর্নিং বডিতে রাখা নারাখা নিয়ে দ্বন্দ্বের কারনে কে বা কারা রাতের অন্ধকারে কলেজটি ভাংচুর করে আগুন লাগিয়ে দেয়। ধ্বংস হয় মেডিকেল কলেজ। ফেনী পলিটেকনিকে ভিপি জয়নালের নেতৃত্বে জাসদ ছাত্রলীগ সক্রিয় ছিলো। আওয়ামী ছাত্রলীগ নিষিদ্ধ ছিলো। ফলে সেখানেও ভাংচুর চলে। বন্ধ হয়ে যায় পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট। এসকল ঘটনা তিনি ঘটিয়েছেন কেউ বলছেনা , কিন্তু ফেনী আওয়ামিলীগের সুপ্রিম কমান্ডার হিসেবে তাঁর দায় এড়ানোর সুযোগ ছিলোনা। এছাড়া ফেনী শহরের উন্নয়ন স্বাধীনতার পর থেকে মানুষ কখোনো দেখেনি। ফলে সাধারন মানুষের মনে চাপা ক্ষোভ অভিমান সবসময় বিরাজমান ছিলো। বিশেষভাবে মেডিকেল কলেজ ধ্বংস হবার পর আমরাও মানুষের কাছে ছোট হয়ে গিয়েছিলাম। আজ এটা ফেনীর একটি সম্পদ হতে পারতো।

সেখানে আজ আমাদের ছেলেমেয়েরাও পড়তে পারতো। আজ ফেনীর আধুনিক যে রুপ আমরা দেখি তা প্রয়াত মেয়র আফসার উদ্দিনের অবদান। তাঁর মৃত্যুর পর বর্তামান সাংসদ জনাব নিজাম উদ্দিন হাজারীও এর সিংহভাগ প্রশংসা প্রাপ্য। মূলত তিনিই আসলে আধুনিক উন্নত ফেনীর রুপকার। আজ ফেনী , ঢাকা বা সিলেটের পর তৃতীয় উন্নত শহর , তাঁরই কারনে। এবং এখানেই জয়নাল হাজারী ও জনাব নিজাম উদ্দিন হাজারীর পার্থক্য। নিজাম হাজারী অল্পকদিনের প্রচেষ্টা ও পরিশ্রমে ফেনীকে যে উচ্চতায় নিয়ে গিয়েছেন , দুঃখের বিষয় জয়নাল হাজারী তা ত্রিশ বছরেও পারেননি। কেনো তিনি এত উদাসিন ছিলেন ? আমার মনোবিজ্ঞানী এক বন্ধুর মতে , প্রেমে ব্যর্থ আজীবন অকৃতদার একজন মানুষ জয়নাল হাজারী , ইতিবাচক চিন্তায় সংকীর্ণ হয়ে পড়েন। ফলে সকল নেতিবাচক কর্মকাণ্ড তখন তার মধ্যে মাথাচাড়া দেয়। হাজারী কি যৌবনে প্রেমে ব্যর্থতার কারনেই সব নষ্ট করে দিয়েছিলেন ?

অতিরিক্ত আবেগ মানুষকে নেতিবাচক করে দেয় , তিনি তার শিকার ? আমি জয়নাল হাজারীকে খুব কাছ থেকে দেখেছি। দলের জন্য তিনি যেমন শতভাগ নিবেদিতপ্রাণ ছিলেন তেমনি তাঁর সমালোচক ও ভিন্ন মতাবলম্বী বা ভিন্ন দলের প্রতি তিনি ছিলেন তেমনি বিপজ্জনক। এটাই তাকে ইতিবাচক কাজকর্ম থেকে দূরে রেখেছিলো। কিন্তু তারপরও তিনি দলের দুর্দিনে যেভাবে আওয়ামী লীগকে নেতৃত্ব দিয়েছেন আগলে রেখেছেন , শত প্রতিকুলতার মধ্যেও যেমনি কর্মীদের তার কারিশমা দিয়ে সফল কমান্ডারের মতো নেতৃত্ব দিয়েছেন তা এককথায় সেসময়ে অসম্ভব ছিল। এখন এই তথ্যপ্রযুক্তির যুগে যা কল্পনাও করা যায়না। টাকা দিয়েও এখন যেখানে কর্মী ভাড়া করতে কষ্ট হয় , সেখানে আমরা ৯০র দশকে নিজের পকেটের পয়সা খরচ করে জয়নাল হাজারীর পিছনে আন্দোলন সংগ্রাম করেছি , সাংগঠনিক কর্মকাণ্ড করেছি। তিনি আমাদের কোনো টাকা পয়সা দিতেননা। এযুগে কেউ তা হয়তো বিশ্বাসও করবেনা। আমাদের সময়ের অনেকেই এখন প্রয়াত। খসরু ভাই , অনুজ একরাম , বন্ধু বেন্টু হাজারী , এমন অনেকেই আজ নেই। আমরাও যারা তাদের সহযোদ্ধা ছিলাম , তারাও আজ বেঁচে নাথাকার মতোই বেঁচে আছি। গৌরবের দিনগুলো শেষ হয়ে গেছে , নষ্টালজিয়া পড়ে আছে ….. এতকিছুর পরও জয়নাল হাজারী , জয়নাল হাজারীই , আলোচিত সমালোচিত , নিন্দিত নন্দিত ক্ষণজন্মা কমান্ডার যে এই ফেনীতে একাই আওয়ামী লীগকে টিকিয়ে রেখেছিলো ত্রিশ বছরেরও অধিককাল যা আজ ইতিহাস , যা নতুন প্রজন্ম জানবে আর নেতৃত্বের জন্য উদ্বুদ্ধ হবে। তাঁর গল্প শুনবে , দলের জন্য আনুগত্য আর দেশপ্রেমের অমর দীক্ষায় অনুপ্রাণিত হবে……. জয়নাল হাজারীরা যায় নীরবে ……. রেখে যায় উদাহরণ …… পরবর্তী প্রজন্মের জন্য…. ফর ইউর প্যাট্রিওটিজম এন্ড ডিগনিটি ফর দ্য পার্টি , স্যালুট ইউ স্যার …….. ( For your patriotism & dignity for the party ….. I salute you sir …………..

SHARE THIS ARTICLE