টক অফ দি ন্যাশনঃ হেফাজতে ইসলাম ও মামুনুল হক (ভিডিও)

ডাঃ জিন্নুরাইন জায়গীরদারঃ গত ৩রা এপ্রিল শনিবার নারায়নগঞ্জের সোনারগাঁয়ে ঘটে যাওয়া একটি ঘটনা এবং সেই ঘটনার পূর্ববর্তী আর পরবর্তী ঘটনাসমূহ বাংলাদেশের পুরো জাতির আলোচনা আর সমালোচনার বিষয়বস্তু হয়ে উঠেছে। এই বিষয়টা এখন আর টক অফ দা টাউন নয় এখন বিষয়টা টক অফ দা ন্যাশন হয়ে গিয়েছে। ৩রা এপ্রিল শনিবার বিকেল ৩টায় সোনারগাঁয়ের রয়েল রিসোর্টের ৫ম তলার ৫০১ নম্বর কক্ষে একজন মামুনুল হককে নারীসহ অবরুদ্ধ করে স্থানীয় লোকজন। স্থানীয় লোকজন কারা ছিল, সেটা অজানা নয়। সংবাদে প্রকাশ এরা ছিল বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের স্থানীয় কর্মি আর নেতৃবৃন্দ। স্থানীয় লোকজনের ধারাবাহিকতায় এসেছেন মেডিয়া এবং পুলিশ আর তারপর যারা এসেছেন তাদের বয়ান একটু পর দেয়া যাবে।

যে মামুনুল হককে ঘেরাও করা হলো তিনি কোন একজন সাধারণ ব্যাক্তি নন। তিনি বাংলাদেশের একজন বিশিষ্ট ব্যাক্তিত্ত্ব। আর এই ঘটনার মাধ্যমে তিনি হয়ে উঠেছেন বিশিষ্টের চেয়ে বিশিষ্ট। মামুনুল হকের পিতা মৌলানা আজিজুল হক ছিলেন একজন স্বনামধন্য শায়খুল হাদিস। তিনি সহি হাদিস গ্রন্থ বুখারির প্রথম বাংলা অনুবাদ করেছিলেন। তার হাত ধরেই প্রতিষ্ঠিত হয় “খেলাফতে মজলিস” নামক  রাজনৈতিক দল। ঢাকার মুহাম্মাদপুরের নিকটে তিনি প্রতিষ্ঠা করেন জামেয়া মুহাম্মাদিয়ে আরাবিয়া নামের মাদ্রাসা। 


শায়খুল হাদিস আল্লামা আজিজুল হকের সন্তান মৌলানা মামুনুল হক শায়খুল হাদিস হিসাবেই তার পিতার প্রতিষ্ঠিত মাদ্রাসা জামেয়া মুহাম্মাদিয়া আরাবিয়ায় শিক্ষকতা করে আসছেন। তিনি মাদ্রাসা শিক্ষকদের সংগঠন “হেফাজতে ইসলামের” যুগ্ম মহাসচিব এবং রাজনৈতিক দল “খেলাফতে মজলিশের” মহাসচিব। হেফাজতে ইসলাম, বাংলাদেশের মাদ্রাসা শিক্ষক আর ছাত্রদের প্রতিনিধিত্বকারী সংগঠন। সাম্প্রতিক সময়ে বিগত ২৬শে মার্চ বাংলাদেশের স্বাধীনতার সুবর্ন জয়ন্তী উপলক্ষে রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠানে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর অতিথি হিসাবে আমন্ত্রণ এবং উপস্থিতির বিরোধিতা করে হেফাজতে ইসলাম। এই বিরোধিতার মুখপাত্র হিসাবে জনাব মামুনুল হক মুখ্য ভূমিকা পালন করেন। মোদী বিরোধী আন্দোলন সহিংস রূপ লাভ করে এবং সঙ্ঘর্ষে ২০ জনের মত হেফাজত কর্মী মৃত্যুবরণ করে। সরকার বিরোধী এই আন্দোলনের মূল নায়ক হিসেবে আবির্ভুত হন এই মামুনুল হক।

এবার আমরা আসি আসল ঘটনায় গত ৩রা এপ্রিল এই মামুনুল হক সোনারগাঁয়ের রয়েল রিসোর্টের ৫ম তলার ৫০১ নম্বর কক্ষে অবরুদ্ধ হন সরকার দলীয় কর্মিদের দ্বারা, এটা ছিল ঘটনার প্রথম পর্ব। যারা অবরোধ করেন, তারা পুরোটাই লাইভে সম্প্রচার করেন। এতে দেখা যায় মামুনুল হককে শারীরিক হেনস্থা করা হয়, তার গায়ের পাঞ্জাবির হাতের কিয়দংশ ছিঁড়ে যায়।

প্রথমত তাকে বেশ নার্ভাস মনে হলেও দ্রুত পরিস্থিতি সামলে নেন। প্রতীয়মান হয় যে, রাজনৈতিক কর্মীরা তাকে ঐ রিসোর্টে একজন নারীসহ পাকড়াও করে। তারা এই নারীকে দেহপসারিনি হিসেবে প্রমাণ করতে চেয়েছে। যেখানে মামুনুল হক বলেছেন, এই নারী তার বৈধ দ্বিতীয় স্ত্রী, তার বন্ধুর তালাকপ্রাপ্তা। মামুনুল হক জানান তিনি সোনারগাঁয়ে স্ত্রীকে নিয়ে বেড়াতে আসেন এবং রিসোর্টে বিশ্রামের উদ্দেশ্যে আসেন। এক পর্য্যায়ে মারমুখী রাজনৈতিক কর্মিরা তার কাবিননামাও দেখতে চায়। 


ঘটনার দ্বিতীয় পর্বে পুলিশ উপস্থিত হলে তারাও এই মর্মে মামুনুল হককে জিজ্ঞাসাবাদ অব্যাহত রাখে। এরপর আসে ঘটনার তৃতীয় পর্ব যেখানে সংবাদ পেয়ে হেফাজতের হাজার হাজার কর্মী রিসোর্ট আক্রমণ করে প্রচুর ভাংচুর করে এবং সর্বসমক্ষে তাদের নেতা মামুনুল হককে উদ্ধার করে সেখান থেকে নিয়ে চলে যায়। এক কথায় বলা যায় মাদ্রাসা ছাত্ররা মামুনুল হককে পুলিশের হাত থেকে ছিনিয়ে নিয়ে যায় আর অন্যভাবে বলা যায় পুলিশ তাদের হাতে মামুনুল হককে সমর্পন করে পরিস্থিতি সামাল দেয়। 


আক্রান্ত হওয়ার পর মামুনুল হক স্থানীয় সাংবাদিকদের বলেন, ‘আমি আমার দ্বিতীয় স্ত্রীকে নিয়ে শনিবার দুপুরে অবকাশ যাপনে এ রিসোর্টে এসেছি। সেখানে আমাকে হেনস্তা করা হয়েছে। আমরা জাদুঘর ঘুরে বিশ্রাম নেওয়ার জন্য এখানে এসেছিলাম।’

এদিকে নারায়ণগঞ্জের পুলিশ সুপার মোহাম্মদ জায়েদুল আলম সংবাদমাধ্যমকে জানান, মামুনুল হক নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁও থানাধীন রয়েল রিসোর্টের একটি কক্ষে নারীসহ অবস্থান করছেন- এমন খবরে স্থানীয় লোকজন রিসোর্ট ঘেরাও করে। পরে খবর পেয়ে পুলিশ সেখানে যায়। মামুনুল হকের সঙ্গে থাকা নারী তার দ্বিতীয় স্ত্রী বলে জানালে পুলিশ তাকে নিরাপত্তা দিয়ে সেখান থেকে উদ্ধার করে। পরবর্তীতে পুলিশ শান্তিশৃঙ্খলা রক্ষায় তাকে হেফাজতের হাতে অর্পন করতে বাধ্য হয়।

তাকে মুক্ত করে নিয়ে হেয়াজত কর্মিরা পুরো এলাকা জুড়ে পথ ঘাট বন্ধ করে সমাবেশ করে, সেই সমাবেশে মামুনুল হক সহ নেতৃবৃন্দ বক্তব্য প্রদান করেন। পরবর্তিতে পুলিশের সহায়তায় রাস্তাঘাট মুক্ত করা হয়।

ঘটনা এখানেই শেষ হয়নি, ব্যাপারটা এক ধরনের ধারাবাহিক ঘটনার জন্ম দেয়। মামুনুল হক ফেইসবুক লাইভে একটি বক্তব্য প্রকাশ করেন, সেখানে তার পাশে উপস্থিত ছিলেন তার দুই ভাই এবং একজন হেফাজতের নেতা। লাইভে তার বক্তব্যে তিনি বলেন, তার দ্বিতীয় স্ত্রীকে নিয়ে তিনি অবকাশ যাপনে রিসোর্টে গেলে তাকে ঘেরাও করা হয়। তিনি হলপ করে জানান তিনি তার বিবাহিত স্ত্রীকে নিয়ে সেখানে গিয়েছিলেন এবং যারা তাকে হেনস্থা করেছেন তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যাবস্থা গ্রহণ করবেন।

এদিকে হেফাজতে ইসলামের পক্ষ থেকে প্রেস কনফারেন্স এবং প্রতিবাদ সভার আয়োজন করা হয় অন্যদিকে ফেইসবুক এবং ইউটিউব জুড়ে প্রকাশিত হতে থাকে ব্যাক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক এবং রাজনৈতিক আলাপের অডিও এবং ভিডিও ক্লিপ। এগুলোর সত্য মিথ্যা যাচাই করার অবকাশ না থাকায় বাড়তে থাকে বিভ্রান্তি। বেশ কিছু টকশো এই আলোচনাকে আরও মাত্রা প্রদান করে। তবে সবচেয়ে আলোচিত হয় যখন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা স্বয়ং সংসদে উপস্থিত হয়ে এই ব্যাপারে একটি বক্তব্য উপস্থাপন করেন। প্রধানমন্ত্রী ও সংসদ নেতা শেখ হাসিনা জাতীয় সংসদে বলেন, “হেফাজত আগুন নিয়ে খেলছে। এক ঘরে আগুন লাগলে সেই আগুন অন্য ঘরেও চলে যেতে পারে। সেটা কি আপনাদের হিসেবে নেই।” তিনি বলেন, “একজন মুসলমানের দায়িত্ব আরেকজন মুসলমানের জানমাল হেফাজত ও রক্ষা করা। কিন্তু হেফাজতের নামে তারা জ্বালাও-পোড়াও করে যাচ্ছেন। পবিত্র ইসলাম ধর্মকে তারা ছোট করে দিচ্ছেন। কিছু লোকের জন্য এই ধর্মে জঙ্গি ও সন্ত্রাসীদের নাম জুড়ে যাচ্ছে।” 

প্রধানমন্ত্রী হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে বলেন, “এসব বরদাস্ত করা হবে না। আইন তার নিজস্ব গতিতে চলবে। অপকর্মের সঙ্গে যারা জড়িত তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।” তিনি আরও বলেন, “তাদের কারণে ২৬ মার্চ অনেক মানুষের জীবন গেছে, এর জন্য দায়ী তো তারা। আর বিএনপি-জামায়াত তাদের মদদ দিচ্ছে। এই লজ্জা শুধু বাংলাদেশের জনগণের না, এই লজ্জা পৃথিবীর সব মুসলমানের।” শেখ হাসিনা বলেন, “এরা ধর্মের নামে ব্যবসা শুরু করেছে। এদের এত অর্থ কোথা থেকে আসে? এই বিনোদনের টাকা কোথা থেকে আসে সেটাও একটা প্রশ্ন। হেফাজতের কর্মকান্ড জনগণ দেখেছে। এর বিচার দেশবাসী করবে, আর আইন তার আপন গতিতে চলবে। সংসদ নেতা বলেন, “ইসলাম শান্তির ধর্ম। পবিত্র ধর্মকে সম্পূর্ণভাবে নষ্ট করে দিচ্ছে তারা। তাদের কর্মকান্ডের জন্য বহু মানুষের জীবন গেছে। ২৬ মার্চ অনেক মানুষের জীবন গেছে। এর জন্য দায়ী তো তারা। আমি শুধু এইটুকু বলব, দেশবাসী যেন একটু ধৈর্য ধরেন। আমার কাছে বিস্তারিত তথ্য আছে। আমাদের সবাইকে ধৈর্য ধরেই এগোতে হবে।”

তিনি বলেন, “যখন স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী পালন করি তখন শুরু করল হেফাজতের তান্ডব। হেফাজত তো একা নয় হেফাজতের সঙ্গে জামায়াত-বিএনপিও জড়িত। তাদের প্রত্যেকটা কর্মকান্ডে দেখা যায়। হেফাজতের সবাই যে এর মধ্যে জড়িত তাও কিন্তু না। এটাও বাস্তবতা। তারপরেও দেখেছি ২৬ মার্চ হেফাজত একটা গুজব ছড়াল। কী বায়তুল মোকাররমে মানুষ মারা হয়েছে ইত্যাদি ইত্যাদি। তারা ২৬ মার্চ থেকে ৩১ মার্চ পর্যন্ত যে সহিংসতা চালায় এবং ২৭ ও ২৮ মার্চ হেফাজত এবং বিএনপি-জামায়াতের বিবৃতি দেশবিরোধী ষড়যন্ত্রের ধারাবাহিক অংশ। ২৮শে মার্চ হরতাল দিয়ে সারা দেশে পরিকল্পিতভাবে তারা তান্ডব চালায়। আওয়ামী লীগ অফিস, দলীয় নেতা-কর্মীদের বাড়ি ঘর, সরকারি অফিস আদালত, পরিবহনে হামলা ও ভাঙচুর এবং পোড়ানো হয়। তিনি বলেন, আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের বাড়ি ঘর বেছে বেছে পোড়ানো হয়। তারা ছোট শিশুদের সামনে নিয়ে এসেছে। তাদের হাতে লাঠি অস্ত্র এবং সবার ব্যাগের ভিতরে বিস্ফোরক দ্রব্য নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। কোরআন শরিফ পুড়িয়ে দিয়েছে। কী ধর্মে বিশ্বাস করে যে তারা কোরআন শরিফ পর্যন্ত পোড়ায়। ইসলাম তো শান্তির ধর্ম। ইসলাম ধর্মের নামে এই জ্বালাও পোড়াও এটা কীভাবে আসল। ২০১৩ সালে দেখেছি বিএনপি-জামায়াত কীভাবে চলন্ত গাড়িতে আগুন দিয়ে পুড়িয়েছে। কোনো কিছু হলেই আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীদের বাসায় আগুন দেওয়া। আগুন নিয়ে খেলছে তারা। এক ঘরে আগুন লাগলে তো সেই আগুন অন্য ঘরেও চলে যেতে পারে। সেটা কি তাদের হিসেবে নেই। রেলস্টেশন, ভূমি অফিস, ডিসি অফিস সব জায়গায় তারা আগুন দিয়ে বেড়াচ্ছে। তাদের বাড়িঘর সেগুলোতে যদি আগুন লাগে তখন তারা কী করবে? জনগণ কি শুধু বসে বসে এগুলো সহ্য করবে?

হেফাজত নেতা মামুনুল হকের ঘটনা নিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, “গত শনিবার আপনারা দেখেছেন। রিসোর্টে নারী নিয়ে অবস্থান এবং সেখানে হেফাজতের ভাঙচুরের ঘটনা। এদের চরিত্রটা কী তা বলতে চাই না। ধর্ম ও পবিত্রতার কথা বলে অপবিত্র কাজ করে ধরা পড়ে। সোনারগাঁয়ে রিসোর্টে হেফাজতের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ধরা পড়ল। তা ঢাকার জন্য নানা রকম চেষ্টা করেছে তারা (হেফাজত)। ওই নারীকে মামুনুল হক বউ হিসেবে পরিচয় দেয়। আবার নিজের বউয়ের কাছে বলে অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে আমি এটা বলেছি, মানে এই পরিচয় দিয়েছে। যারা ইসলাম ধর্মে বিশ্বাস করে তারা এরকম মিথ্যা কথা বলতে পারে, অসত্য কথা বলতে পারে? তারা কী ধর্ম পালন করবে, মানুষকে কী ধর্ম শেখাবে? কয়েক দিন আগুন দিয়ে পুড়িয়েছে, এখন সুন্দরী নারী নিয়ে বিনোদন করতে গেলেন! ইসলাম পবিত্র ধর্ম, সেই পবিত্র ধর্মকে এরা কলুষিত করছে। বিনোদনের এসব অর্থ আসে কোথা থেকে?

প্রধানমন্ত্রীর এই বক্তব্যের পর মামুনুল হক এর প্রতিবাদ করে ফেইসবুক লাইভে আবার বক্তব্য দিয়ে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়েছেন। মামুনুল হক শপথবাক্য উচ্চারণ করে বলেছেন, এই মহিলা তার বিবাহিত স্ত্রী। এর পর পরস্পবিরোধি বক্তব্য, ভিডিও, টেলিফোন ক্লিপ, আলোচনা আর সমালোচনা অব্যাহত আছে।

বিশ্লেষণঃ বাংলাদেশে ঘটনা জন্ম নেয় আর সেই ঘটনাকে বিভ্রান্তিতে রূপান্তরিত করতে আমাদের জুড়ি নেই। অতীতের অনেক ঘটনাই বিভ্রান্তিতে রূপান্তরিত হয়েছে বারে বারে এবং পরবর্তী সময়ে সত্য আর অসত্যের বেড়াজালে ঝুলে আছে দীর্ঘদিন। হাজারো উদাহরণ দেয়া যায়, তবুও এই মুহূর্তে মনে আসা একটি দুটি উদাহরণ দেয়া যায়। সম্ভবত ২০১৭ সালের শেষের দিকে বিশিষ্ট সাহিত্যিক, কলামিস্ট, সমালোচক জনাব ফরহাদ মাজহারের ঘটনাটি টক অফ দি ন্যাশন হয়েছিলো। ফরহাদ মাজহার অপহৃত হয়েছিলেন নাকি নিজেই গা ঢাকা দিয়েছিলেন তা এখনো বিভ্রান্তিতে নিমজ্জিত। তার ব্যাপারেও নারী সংক্রান্ত বিষয় চিত্রায়িত হয়েছিলো। অনেক সংবাদ বিশ্বাসযোগ্য বলে প্রতীয়মান হয়নি সমালোচকদের কাছে আবার অতিবিশ্বাসযোগ্য হিসেবে গ্রহণযোগ্য হয়েছে একটি পক্ষের নিকট। সংবাদ মাধ্যম সত্য প্রকাশ করেন নি কিংবা করতে পারেননি। কোন একটা বস্তুনিষ্ঠ সম্পুর্ন প্রতিবেদন কোথাও পরিবেশিত হয়েছে বলে জানা নেই। রাষ্ট্রযন্ত্র কি ইচ্ছে করেই বিভ্রান্তি ছড়ায় সেটাও প্রশ্ন ছিল এবং আজো আছে। আরেকটি ঘটনার উদাহরণ দেয়া যাক, বাংলাদেশের একজন পালিয়ে বিদেশে চলে যাওয়া প্রধান বিচারপতির ব্যাপারেও জাতীয় বিভ্রান্তি আছে। সেই প্রধান বিচারপতির ঘটনা টক অফ দি ন্যাশন থেকে আজ টক অফ দি ইন্টার্নেশন হয়েছে। মোদ্দা কথায় রাষ্ট্রযন্ত্র সরকার বিরোধীদের হেনস্থা করতে সর্বদাই কার্য্যকর। তাই এক কথায় বলা যায়, দেশে বিশ্বাস নামক শব্দটির মৃত্যু হয়েছে। দেশে যেহেতু বিশ্বাসের মৃত্যু হয়েছে তাই কেউ কাউকে বিশ্বাস করেনা। ইউটিউবে কিংবা সংবাদ মাধ্যমে প্রচারিত তথ্যাবলির কোনটা সত্যি আর কোনটি মিথ্যা সেটা বলা অত্যন্ত দুরূহ ব্যাপার। আইন এবং বিচারব্যাবস্থা পর্য্যন্ত আজ অবিশ্বাসের মরুভূমিতে নিমজ্জিত হয়েছে। এখানে মন্ত্রী, সান্ত্রী থেকে শুরু করে মায় বিচারপতিদের বক্তব্যে আস্থা রাখা যায়না, এর সাথে যুক্ত হয়েছেন মৌলভী আর মোল্লারা।

তবে কিছু কথা আমাদের নিকট দীপ্যমান হয়ে আছে। প্রথমতঃ একজন নাগরিকের অধিকার। বেশ কিছু আইনজ্ঞ এই অভিমত দিয়েছেন যে, একটি দেশের একজন নাগরিককে দেশের যে কোন প্রান্তে ঘুরে বেড়াবার অধিকার দিয়েছে দেশের সংবিধান; আর সেই অবস্থায় প্রতিটি নাগরিকের সুরক্ষার দায়িত্ব রাষ্ট্রের উপর বর্তায়। এই অবস্থায় একটি রিসোর্টে অবস্থান নেয়া কোন নাগরিককের সুরক্ষার দায়িত্ব রিসোর্টের উপর যেমন বর্তায় রাষ্ট্রযন্ত্রের উপরেও বর্তায়। এখানে রাষ্ট্রের আইনরক্ষাকারি দায়িত্বশীল ব্যাতিরেকে কারো কোন অধিকার নেই একটি রিসোর্টের অভ্যন্তরে এসে কারো ব্যাক্তিগত অধিকার হরণ করবেন। মামুনুল হকের ঘটনা একটি ভয়াবহ চিত্র হিসেবে ইতিহাসে স্থান পাবে, মামুনুল হকের মত একজন প্রভাবশালী ব্যাক্তিকে যদি এরকম নাজেহাল হতে হয় একটি দলের কর্মিদের নিকট তাহলে সাধারণ নাগরিকদের হাল কি তা সকলেই বুঝতে পারেন। ফেইসবুকে আজ এই প্রশ্নটি অনেকের নিকট, “তাহলে কি প্রতিটি নাগরিকের কাবিননামা গায়ে ঝুলিয়েই হাঁটতে হবে?” তাহলে কি রাস্তাঘাটে যে কোন কেউ কাউকে জিজ্ঞাসাবাদ করে বিবাহের বৈধতা নিয়ে হেনস্থা করে লাইভ মেডিয়ায় প্রকাশ করে দিতে পারবে? এই রকম পরিস্থিতি হলে এই দেশকে কি আদৌ সুস্থ স্বাভাবিক রাষ্ট্র বলে গ্রহণ করা যায়? প্রবাসী একজন বিশেষ ব্যাক্তি আমাকে জিজ্ঞাসা করলেন, “তাহলে আমি যদি আগামী দিন আমার স্ত্রী কিংবা কোন মহিলা নিয়ে দেশে যাই এবং কোন রিসোর্টে উঠি, তাহলে যে কোন সময় যে কোন কেউ এসে আমাকে হেনস্থা করে লাইভ করে দেয়াটা বৈধ বলেই বিবেচিত হবে? এটা কি কোন রাষ্ট্র হলো?” আমরা মনে করি, এই কাজটা মোটেও সঠিক হয়নি এবং যে কোন দলীয় সদস্যই হয়ে থাকেন না কেনো, এদের বিরুদ্ধে দ্রুত ব্যাবস্থা নেয়া রাষ্ট্রের কর্তব্য। এই কথা দেশে কেউ বলছেনা আর কেউ করছেওনা। তাহলে কি পুলিশ, মেডিয়া এবং রিসোর্টের কর্মীরা এই ষড়যন্ত্রের অংশীদার?

দ্বিতীয়তঃ বাংলাদেশে রাজনীতি আর ধর্ম দীর্ঘদিন থেকে নষ্টদের হাতে চলে গিয়েছে। রাজনীতিতে যেমন মূল্যবোধ নেই, ধর্মও আজ রাজনীতির ক্রীড়নক। মামুনুল হকের মত মানুষ কিভাবে এত অবিবেচক এবং অদূরদর্শী কাজ করলেন সেটা এখন অনেকের মুখে মুখে ভাসছে। দ্বিতীয় বিয়ে ইসলামে সিদ্ধ বটে কিন্তু লুকিয়ে বিয়ে কোনভাবেই পরিবার কিংবা সমাজ সিদ্ধ হতে পারেনা। এটা মুটামুটীভাবে পরিষ্কার যে, তার পরিবার এই বিয়ে সম্পর্কে ওয়াকিবহাল ছিলেন না আর ওয়াকিবহাল থাকলেও এধরনের একজন ব্যাক্তি যখন দেশে তার নেতৃত্বে চলছে আন্দোলন, তার কথায় ১৭-২০ জনের জীবন ঝরে গেছে এমতাবস্থায় কিভাবে মামুনুল হক প্রশ্নবিদ্ধ দ্বিতীয় স্ত্রী নিয়ে অবকাশ যাপনে রিসোর্টে যেতে পারেন সেটা আমাদের বোধগম্য হয়না। কিন্তু এগুলো সামাজিক নীতি নৈতিকতার কথা, বিধির কথা নয়। তার কি একথা জানা ছিলনা যে, তিনি ব্যাক্তি নন, তিনি একটি প্রতিষ্ঠান। এই দুর্নাম শুধু তার পরিবারের দুর্নাম নয়, হেফাজতে ইসলামের দুর্নামের সাথে ইসলাম ধর্মও কালো রঙে রঞ্জিত হলো। আর ইউ টিউবে তার টেলিফোনের যে অডিও প্রকাশিত হয়েছে, সেই কথাগুলো সত্যি হলে তিনি ধর্ম আর নীতি দুটো থেকেই বিচ্যুত হয়েছেন। যদি তিনি প্রথম স্ত্রীর নামে সত্যি রিসোর্টে রুম বুকিং দিয়ে অন্য নারী নিয়ে গিয়ে থাকেন তাহলে সেটাও অবৈধ এবং অনৈতিক ছিল। তবে আমরা এখন আর সরকারি সংস্থার উপর বিশ্বাস রাখতে পারিনা আর না রেখেও দেশের নাগরিকের কোন উপায় নেই। মানুষ আজ বড়ই অসহায়।

তৃতীয়তঃ আমরা মনে করি একটি রাষ্ট্রের নাগরিক অধিকার সুরক্ষিত হোক। যারা এই রিসোর্টে গিয়ে তাকে নাজেহাল করেছেন তাদের শাস্তি হওয়া অত্যাবশ্যক। আবার যে হাজারো কর্মীরা, আইন ভেঙ্গে, রিসোর্ট ভেঙ্গে মামুনুল হককে ছিনিয়ে এনেছেন তাদের অপরাধও মারাত্নক, তাদেরও শাস্তি অত্যাবশ্যক। ভিডিওতে দেখা যায় রিসোর্ট ধ্বংসের চূড়ান্ত তাণ্ডব। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী যারা উভয় পরিস্থিতিতে আইন শৃঙ্খলা রক্ষায় দাঁড়াতে পারেনি তাদের শাস্তি হোক সেটাও কাম্য। এরপর আসবে মামুনুল হকের কথা। মামুনুল হক দুইগুণ তিনগুণ অপরাধ করেছেন। ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে তার অপরাধের মাত্রা সীমাহীন। কিন্তু রাষ্ট্রীয় বিধি কোথায় তিনি লঙ্ঘন করেছেন? রিসোর্টে স্ত্রী ছাড়া কোন পার্লার কর্মীকে নিয়ে যাবার অধিকার কি তার আছে? যদি তিনি তার স্ত্রীর পরিচয় মিথ্যা নাম ঠিকানা দিয়ে রিসোর্টে রুম ভাড়া নিয়ে থাকেন তাহলে অবশ্যই তার বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যাবস্থা নেয়া হোক। আর তিনি যদি এই নারীকে বিয়ে না করে বৈধ স্ত্রী দাবী করে থাকেন, সেটারও বিচার হওয়া অত্যাবশ্যক।



বাংলাদেশে আইন নিজস্ব গতিতে চলেনা সেটা আমাদের অনেকেরই অজানা নয়। আইন, রাজনীতির হাত দিয়ে পরিচালিত হয়। বাংলাদেশে সকল কিছুই সরকারের নিজস্ব নীতিতে চলে তার প্রমাণ আমরা বারে বারেই দেখেছি। এব্যাপারে ফরহাদ মাজহার এবং একজন প্রধান বিচারপতির ঘটনা বিবেচ্য। এই দুটো ঘটনা শুধুমাত্র হিমবাহের অগ্রভাগ (টিপ  অফ দি আইসবার্গ)।

একটি দেশের প্রধানমন্ত্রীর কিছু উক্তি অত্যন্ত বিব্রতকর মনে হয়েছে। এখনো প্রমাণিত হয়নি এধরনের বিষয় নিয়ে ব্যাক্তি চরিত্রে আঘাত, পার্লার কর্মি বলে পুরো একটি পেশাকে জড়িয়ে বিষোদগার। রাজনীতি ও ধর্মকে এক প্রান্তে দাঁড় করিয়ে কটূক্তি। এসবের জন্য কিন্তু প্রধানমন্ত্রীর দায়, জাতিকে বহন করতে হবে। অনেকের নিকট নেতৃর বক্তব্য শোভনীয় মনে হয়নি।

পরিশেষে আমি বলতে চাই, একটি মিথ্যা হাজারো মিথ্যার মালা তৈরি করে। একটি অন্যায় হাজারো অন্যায়ের জন্ম দেয়। একটি অবৈধ কাজ হাজারো অবৈধ কাজের মালা তৈরি করে। ইংরেজিতে বলে “চেইন অব ইভেন্টস”। অন্যায়, অসত্য, অবৈধ, অনৈতিক কাজ ব্যাক্তিজীবনে যেমন পরিত্যাজ্য তেমনি পারিবারিক, সামাজিক, রাষ্ট্রীয় জীবনেও পরিত্যাজ্য। অশোভন, অশালীন কাজ অন্যায়; নীতিহীন কাজ কোনভাবেই ভবিষ্যতের শুভ লক্ষণ নয়। কোন না কোন ভাবে ব্যাক্তি, পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রকে এর পরিণতি বহন করতে হবে। ইতিহাসের দিকে তাকালেই আমরা বীভৎস চিত্র দেখতে পাই। যেভাবে দেশে রাজনীতি সংজ্ঞাহীন,  বিচারব্যাবস্থা অচেতন, গণতন্ত্র মৃতবৎ, সেখানে অনাগত ভবিষ্যৎ কি আলো হাতে এগিয়ে আসবে নাকি কালো অন্ধকার ভবিষ্যতকে গ্রাস করবে দেখার জন্য বিবেকবান জাতি নিদ্রাহীন অপেক্ষায়। 

SHARE THIS ARTICLE