আইরিশ বাংলাপোষ্ট ডেস্কঃ মহামারির ধাক্কায় আয় কমে যাওয়ায় অনেকেই নিজের অ্যাপার্টমেন্ট বিক্রি করে দিয়েছেন। সেসব অ্যাপার্টমেন্ট তুলনামূলক কম দামে কিনে নিয়েছেন মূলত প্রবাসী বাংলাদেশিরা। করোনা মহামারির হাত ধরে নতুন বাস্তবতার মুখোমুখি মানুষ। নগদ অর্থ কমে এসেছে প্রায় সবার হাতেই। ফলে লোকে জীবনধারণের খরচ পুনঃসামঞ্জস্য করতে অ্যাপার্টমেন্ট বিক্রি করে দিচ্ছে।
গত বছর সম্পত্তি নিবন্ধ অফিসগুলোতে ৮ হাজার কোটি টাকার পুরনো ফ্ল্যাট ক্রয়-বিক্রয় হয়েছে, গত কয়েক বছরে যা রেকর্ড। কোভিডের কারণে নিজের ব্যবহৃত অ্যাপার্টমেন্ট ও ফ্ল্যাট বিক্রি করতে বাধ্য হয়েছেন অনেকেই। আবার প্রবাস জীবনের আয় থেকে অনেকেই ফ্ল্যাট কিনে অর্থ লগ্নি করেছেন।
নবিউল হাসান রাজের কথাই ধরা যাক। রাজধানীর দক্ষিণ বারিধারা ডিআইটি আবাসিক প্রজেক্ট এলাকায় নগর হোমস-এর শীতল ছায়া প্রকল্পে ২০১৮ সালে ৮০ লাখ টাকায় ১ হাজার ১০০ বর্গফুটের একটি ফ্ল্যাট কিনেছিলেন একটি বেসরকারি সংস্থার কর্মকর্তা রাজ। কোভিডের কারণে ২০২০ সালের শেষ দিকে তিনি চাকরিচ্যুত হন। ৩৪ বছর বয়সি রাজ ফ্ল্যাট কেনার ৮০ লাখ টাকার ৪০ লাখ টাকা ঋণ নিয়েছিলেন নিকটাত্মীয়দের কাছ থেকে। কিন্তু চাকরি চলে যাওয়ায় সেই ঋণের টাকা প্রতি মাসে কিস্তি আকারে পরিশোধে ব্যর্থ হন তিনি।
ঋণ পরিশোধ করতে না পারায় গত বছরের অক্টোবরে ফ্ল্যাটটি কেনা দামে বিক্রি করে দেন রাজ। তারপর স্ত্রী-সন্তানকে নিয়ে ভাড়া বাসায় উঠেছেন। ঋণের টাকা পরিশোধের পর কিছু টাকার সঞ্চয়পত্র কিনেছেন, আর কিছু টাকা দিয়ে নতুন একটি ব্যবসা শুরু করেছেন।
রাজের ফ্ল্যাটটি কিনেছেন ওই এলাকার যুক্তরাজ্যপ্রবাসী হতিমুল বারী কচি। তিনি বলেন, ‘সুবিধাজনক লোকেশনে তুলনামূলক কম দামে ব্যবহৃত ফ্ল্যাটটি পেয়েছি। ফ্ল্যাটের সব রকম ইউটিলিটি ও ইন্টেরিয়র ডিজাইন সম্পূর্ণ করা ছিল। ভবিষ্যতে ফ্ল্যাটটি বিক্রয় করলে আরও বেশি দাম পাওয়ার চিন্তা থেকেই এটি কিনেছি।’
২০২১ সালে দেশের বড় শহরগুলোতে পুরনো অ্যাপার্টমেন্টের বিক্রি বাড়ার চিত্র এরকমই। মহামারির ধাক্কায় আয় কমে যাওয়ায় অনেকেই নিজের অ্যাপার্টমেন্ট বিক্রি করে দিয়েছেন। সেসব অ্যাপার্টমেন্ট তুলনামূলক কম দামে কিনে নিয়েছেন প্রবাসী বাংলাদেশিরা।
পুরনো ফ্ল্যাট বিক্রির পরিমাণ বাড়ার আরও বেশ কিছু কারণ রয়েছে। অন্যতম কিছু কারণ হলো—রেডি ফ্ল্যাটের সংখ্যা কমে যাওয়া, নির্মাণ সামগ্রীর বাজারদর অস্বাভাবিকহারে বেড়ে যাওয়ায় নতুন ফ্ল্যাটের দামও বেড়ে যাওয়া কিন্তু পুরনো ফ্ল্যাটের দাম সেই হারে না বাড়া। এসব কারণে লোকে নতুন ফ্ল্যাট না কিনে পুরনো ফ্ল্যাটের দিকে ঝুঁকছে বেশি।
২০২০ সালের জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত পর্যন্ত প্রায় ৬ হাজার কোটি টাকার পুরনো অ্যাপার্টমেন্ট ক্রয়-বিক্রয়ের চুক্তিনামা নিবন্ধন হয়েছে বিভিন্ন সাবরেজিস্ট্রি অফিসে। আর ২০১৯ সালের জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত প্রায় সাড়ে ৫ হাজার কোটি টাকার পুরনো ফ্ল্যাট ক্রয়-বিক্রয়ের চুক্তিনামা নিবন্ধন হয়েছে।
নিবন্ধন অধিদপ্তরের সহকারী মহাপরিদর্শক শেখ মো. আনোয়ারুল হক বলেন, কোভিডকালে দেশের বিভিন্ন শহরে কমার্শিয়াল স্পেস, আবসিক প্লট, পুরনো ফ্ল্যাট কেনাবেচার দলিল ও চুক্তিনামা নিবন্ধনের হার এর আগের দু-বছরের তুলনায় বেশ বেড়েছে।
তিনি বলেন, ‘সম্পত্তি রেজিস্ট্রেশন থেকে গত বছর সরকার প্রায় ১৩ হাজার কোটি টাকার রাজস্ব পেয়েছে। পুরাতন ফ্লাট ক্রয়-বিক্রয়ের চুক্তিনামা নিবন্ধন থেকে প্রায় ১ হাজার কোটি টাকার রাজস্ব আদায় হয়েছে।’
নতুন ফ্ল্যাট কেনার পর সরকারনির্ধারিত যে পরিমাণ ট্যাক্স, ভ্যাট, স্থনীয় সরকার করসহ বিভিন্ন রাজস্ব জমা দিতে হয় ক্রেতাকে, পুরনো ফ্ল্যাট কেনার পর ক্রেতাকে সেই একই পরিমাণ রাজস্ব জমা দিতে হয়। অবশ্য ফ্ল্যাট কেনার চুক্তিপত্র নিবন্ধনের সময় উল্লেখ করতে হয়, সেটি পুরাতন নাকি নতুন।
আবাসন ব্যবসায়ীদের সংগঠন রিয়েল এস্টেট অ্যান্ড হাউজিং অ্যাসোসিয়েশন অভ বাংলাদেশ-এর (রিহ্যাব) পরিচালক নাঈমুল হাসান বলেন, গত দুই বছরে আবাসন খাতে সবচেয়ে বেশি পুরনো ফ্ল্যাট কিনেছেন প্রবাসীরাই।
কারণ হিসেবে তিনি বলেন, ‘এই করোনাকালীন সময়ে ব্যবহৃত বা সেকেন্ডহ্যান্ড ফ্ল্যাটের চাহিদা বাড়ছে। কারণ ব্যবহৃত ফ্ল্যাটে বড় বাসা পাচ্ছেন, তিতাস গ্যাসের লাইন পাচ্ছেন, রেডি ইন্টেরিয়র পাচ্ছেন, আর অনেক কম দামে ভালো এলাকায় থাকার সুযোগ পাচ্ছেন।’
অর্থনীতিবীদ আহসান এইচ মুনসুর বলেন, ২০২০ ও ২০২১ সালে বাংলাদেশ প্রত্যাশার চেয়েও অনেক বেশি প্রবাসী আয় (রেমিট্যান্স) পেয়েছে। গত বছর দেশে প্রবাসী আয় এসেছে ২২ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে বেশি। যা আগের বছরের তুলনায় ৪ দশমিক ৫ শতাংশ বেশি।
তিনি বলেন, ‘প্রবাসীদের বড় অংশই দেশের বাইরে বিভিন্ন কাজ করে। তাদের লক্ষ্য থাকে ভালোভাবে সংসার পরিচালনা আর একটি ভালো আবাসন ব্যবস্থা করা।
‘দেখা যায়, প্রবাসীরা নগদ টাকা সাধারণত বিনিয়োগ করেন সহজলভ্য জায়গায়। সেক্ষেত্রে পুরাতন ফ্ল্যাট বা প্লট কিনেতে তারা বেশি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে। এছাড়াও অনেক ব্যবসায়ী আছেন, তারাও এই খাতে বিনিয়োগ করতে আগ্রহী।’
আহসান এইচ মুনসুর আরও বলেন, নির্মাণ সামগ্রীর বাজারদর অস্বাভাবিক হারে বেড়ে যাওয়ায় নতুন ফ্ল্যাটের দামও অনেক বেড়ে গেছে। কিন্তু পুরনো ফ্ল্যাটের দাম সেই তুলনায় অনেক কম।
নগর পরিকল্পনবিদ ও স্থপতি ইকবাল হাবীব বলেন, ঢাকা মহানগর এলাকায় বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনার (ড্যাপ) যে খসড়া প্রণয়ন করা হয়েছে, তাতে রাজধানী ও পার্শ্ববর্তী বিভিন্ন এলাকায় ভবনের উচ্চতা কমিয়ে আনার প্রস্তাব করা হয়েছে। এছাড়াও ড্যাপ বাস্তবায়ন হলে প্রস্তাবিত নতুন ইমারত নির্মাণ বিধিমালা অনুযায়ী ভবনের চারপাশে এখনকার চেশে প্রায় দ্বিগুণ জায়গা খালি রাখতে হবে।
এ দু্ই কারণে ড্যাপ বাস্তবায়ন হলে ফ্ল্যাটের দাম প্রায় দ্বিগুণ হয়ে যাবে। ফলে অনেকেই এখন তাড়াহুড়া করে রেডি, পুরনো বা ব্যবহৃত ফ্ল্যাট কেনার দিকে ঝুঁকছেন।
রিহ্যাব সভাপতি আলমগীর সামসুল আলামিন কাজল বলেন, এখন যে বিধিবিধান রয়েছে, তা অনুযায়ী রাজধানীতে ৫ কাঠা জমির ওপর প্রায় ২০ হাজার বর্গফুটের স্পেস নিয়ে একটি ভবন নির্মান করা যায়। ড্যাপ বাস্তবায়ন হলে একই পরিমাণ জমির ওপর নির্মাণ করা যাবে মাত্র ১৩ হাজার বর্গফুটের ভবন। এতে অবধারিতভাবেই ফ্ল্যাটের দাম যাবে বেড়ে।
পুরাতন ফ্ল্যাট কেনাবেচার সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিরা বলছেন, রাজধানীর মগবাজার, উত্তরা, বসুন্ধরা, ধানমন্ডি, মোহাম্মদপুর ও মিরপুর এলাকায় পুরনো ফ্ল্যাটের চাহিদা বেশি। পুরনো ফ্ল্যাট কেনার ক্ষেত্রে নতুন ফ্ল্যাটের চেয়ে সাধারণত প্রতি বর্গফুটে ২ হাজার টাকা কম পাওয়া যায়।
তারা জানান, ঢাকার মোহাম্মদপুর এলাকায় বিক্রির জন্য প্রস্তুত পুরোনো ১ হাজার ৩৩৫ বর্গফুটের ফ্ল্যাট বিক্রির জন্য ৬৯ লাখ টাকা দাম চাওয়া হয়েছে। গুলশান এলাকায় ১ হাজার ২৫০ বর্গফুটের পুরনো ফ্ল্যাট বিক্রির জন্য ৫৬ লাখ টাকা দাম ধরা হয়েছে। রাজধানীর বনশ্রী এলাকায় ১ হাজার ৫ বর্গফুট ফ্ল্যাটের দাম চাওয়া হচ্ছে ৪৮ লাখ টাকা।
শিল্প সংশ্লিষ্টরা বলছেন, পুরনো ফ্ল্যাটের দাম শুধু এলাকার ওপর নির্ভর করে না। এ দাম নির্ভর করে ফ্ল্যাটের সার্বিক অবস্থা, যোগাযোগব্যবস্থা, পার্কিং, আশপাশে কী ধরনের স্থাপনা আছে—এসবের ওপর। পাশাপাশি ফ্ল্যাটটি কত দিন ব্যবহার করা হয়েছে, তা-ও দামের ক্ষেত্রে বড় ভূমিকা রাখে।
নতুনের পাশাপাশি পুরনো ফ্ল্যাট বিক্রির মধ্যস্থতা করে বিপ্রপার্টি ডটকমসহ প্রায় ৬টি প্রতিষ্ঠান। প্রতিষ্ঠানগুলোর দায়িত্বশীলদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, তাদের ওয়েবসাইটে এখন পর্যন্ত প্রায় ৪ হাজার পুরনো ফ্ল্যাট বিক্রির বিজ্ঞাপন রয়েছে।
রিহ্যাব সভাপতি আলমগীর সামসুল আলামিন কাজল বলেন, রাজধানীতে এখন যেসব আবাসন প্রতিষ্ঠানের বিভিন্ন প্রকল্প রয়েছে, সেগুলোতে রেডি ফ্ল্যাট পওয়া যাচ্ছে কম। ফলে যারা রেডি ফ্লাট কিনতে আগ্রহী তাদের বেশিরভাগই পুরনো ফ্ল্যাট কেনার দিকে ঝুঁকছেন। সূত্র: টিবিএস