নায়িকা-মডেলদের অন্তরঙ্গ ভিডিও ও স্থিরচিত্র তদন্তে সিআইডি

আইরিশ বাংলাপোষ্ট অনলাইন ডেস্কঃ সিআইডির রিমান্ডে থাকা বিতর্কিত নেত্রী হেলেনা, নায়িকা পরীমণি ও মডেল পিয়াসা- মৌসহ অন্যান্য আসামিদের জিজ্ঞাসাবাদে দেয়া তথ্য নিয়ে একাধিক টিম পৃথকভাবে তদন্ত করছে। গ্রেফতারকৃতরা মাদক ব্যবসা, অবৈধ অস্ত্র চোরাচালানের সাথে জড়িত থাকার অভিযোগ এবং বিত্তশালী ও উচ্চ পদস্থ ব্যক্তিদের সাথে সখ্যতা থাকার তথ্য গণমাধ্যমে প্রকাশ হওয়ায় নড়েচড়ে বসেছেন সিআইডির কর্মকর্তারা। গতকাল থেকে গ্রেফতারকৃতদের তথ্য যাচাই-বাছাই করতে একাধিক সিআইডির টিম মাঠে কাজ করছে। অন্যদিকে আওয়ামী লীগ থেকে বহিষ্কৃত হেলেনা জাহাঙ্গীর, চিত্রনায়িকা পরীমণি, মডেল পিয়াসা, প্রযোজক নজরুল ইসলাম রাজ, মাসুদুল ইসলাম ও শরফুল হাসানের বিরুদ্ধে করা ১০টি মামলার তদন্তভারের অনুমতি চেয়ে পুলিশ সদর দপ্তরে চিঠি দিয়েছে র‌্যাব। গত রোববার এই আবেদন করা হয়। পুলিশ সদর দফতরের অনুমতি মিললে মামলাগুলো র‌্যাব দ্রæততা ও গুরুত্বের সঙ্গে তদন্ত করবে বলে র‌্যাব কর্মকর্তারা জানিয়েছেন।
অন্যদিকে পরীমণির সঙ্গে একটি খ্যাতনামা ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানের কর্ণধারের সম্পৃক্ততা সংক্রান্ত একটি ভিডিও ইউটিউবে আপ করা হয়েছে। এতে তাদের অন্তরঙ্গ মুহূর্তের ভিডিও ও স্থিরচিত্র রয়েছে। একই ভিডিওতে আরো কয়েকজনের সঙ্গে পরীমণির বিশেষ সম্পর্ক থাকার কথাও বলা হয়েছে। এ ভিডিওটি কয়েক ঘণ্টার মধ্যে ভাইরাল হয়েছে। এ সব খতিয়ে দেখছেন তদন্ত সংশ্লিষ্ট সিআইডির কর্মকর্তারা।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামাল সাংবাদিকদের বলেন, চিত্রনায়িকা পরীমণি, মডেল ফারিয়া মাহবুব পিয়াসার সঙ্গে ‘সম্পর্ক থাকা’ অনেকের নামের তালিকা মেলার খবর ছড়ালেও সুনির্দিষ্ট অভিযোগ ছাড়া কাউকে হয়রানি করা হবে না। রিমান্ডে থাকা পরীমণি কিংবা পিয়াসা কি কারও নাম বলেছেন- প্রশ্নে তিনি বলেন, কারো নাম বললেই কি হবে নাকি? যাচাই-বাছাই রয়েছে না। আপনারা (সাংবাদিক) ভালো করে প্রচার করেন যে, কাউকে হয়রানি করা হবে না।
পরীমণিদের বিরুদ্ধে মামলার তদন্ত সংস্থা সিআইডির অতিরিক্ত ডিআইজি শেখ ওমর ফারুক সাংবাদিকদের বলেন, রিমান্ডে জিজ্ঞাসাবাদে অনেক ‘গুরুত্বপূর্ণ তথ্য’ দিয়েছেন আসামিরা। সেসব তথ্য যাচাই করা হচ্ছে। আমরা তাদের কাছ থেকে বিভিন্ন পেশার অনেকের নাম পেয়েছি। কেউ শত্রæতাবশতও দিতে পারে। সিআইডি এগুলো পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে যাচাই করবে। কোনো নিরীহ মানুষ যেন দোষী না হয় সিআইডি এটা দেখছে।
সিআইডির এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করে বলেন, মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইন অনুযায়ী, মাদক ব্যবসা করে কোনো ব্যক্তি যদি অবৈধ সম্পদ অর্জন করেন, তাহলে তার ব্যাংক হিসাব, আয়কর বিবরণী, সম্পদের করসম্পর্কিত যাবতীয় রেকর্ডপত্র যাচাই-বাছাই ও মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইনে ব্যবস্থা নিতে পারবে তদন্ত সংশ্লিষ্টরা। আমরা সে পথেই হাঁটছি। রাজ মাদকের সাপ্লায়ার সে ব্যাপারে তথ্য-প্রমাণ আমরা পেয়েছি। সঙ্গতকারণে তার তার ব্যাংক হিসাব, আয়কর বিবরণী, সম্পদের করসম্পর্কিত যাবতীয় রেকর্ডপত্র যাচাইয়ে বাংলাদেশ ব্যাংককে চিঠি দেয়া হবে।
এদিকে সিটি ব্যাংক লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মাসরুর আরেফিন পরীমণিকে গাড়ি কিনে দিয়েছেন- এ সংক্রান্ত একটি সংবাদ একটি জাতীয় দৈনিকে প্রকাশিত হয়। এর কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই মাসরুর আরেফিন এ সংবাদকে মিথ্যাচার বলে দাবি করেন। পরীমণি ও পিয়াসাকে কখনো দেখেননি বলে দাবি করে তিনি রোববার রাতে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে নিজের অ্যাকাউন্ট থেকে একটি পোস্ট দেন। এতে বলেন, পরীমণি নামের কাউকে তিনি দেখেননি। তার ফোন নম্বর তার কাছে থাকার প্রশ্ন আসে না। তিনি কোনো ক্লাব বা পার্টিতে যান না। তার নিজের কোনো গাড়ি নেই। এ অবস্থায় একজন নায়িকা কিংবা মডেলকে গাড়ি কিনে দেওয়ার প্রশ্ন অবান্তর।
তদন্তে সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানায়, পরীমণি, পিয়াসা, মৌ ও রাজসহ ১০-১২ জনের একটি সিন্ডিকেট অভিজাত এলাকায় নিয়মিত আসর বসাত। আসরগুলোতে মদ পান, ডিজে পার্টিসহ নানা অনৈতিক কর্মকান্ড চলতো। গ্রেফতারকৃত ব্যক্তিদের জিজ্ঞাসাবাদ, মোবাইল ফোন, কললিস্ট, মেসেঞ্জার ও হোয়াটসঅ্যাপসহ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের বিভিন্ন অ্যাপস থেকে সিন্ডিকেটভুক্তদের আসরে যাতায়াত করা শতাধিক ব্যক্তির নাম পাওয়া গেছে। জিজ্ঞাসাবাদে তাদের বিষয়ে অনেক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য মিলেছে। প্রাপ্ত নামের অনেকগুলোই ছদ্মনাম বা সাঙ্কেতিক নাম। সিআইডি তাদের জিজ্ঞাসাবাদ ও প্রযুক্তিগত তদন্তের সহায়তায় প্রকৃত নাম ঠিকানা, পেশা, আয়ের উৎস ইত্যাদি সম্পর্কে জানার চেষ্টা করছে।
সোমবার সিআইডির অতিরিক্ত ডিআইজি ওমর ফারুক বলেন, রাজের বাসা থেকে আমরা গতরাতে (শনিবার) দুটি গাড়ি জব্দ করেছি। গাড়ি দুটো কীভাবে কেনা, গাড়ি দুটি কার নামে কেনা, কোথায় থেকে, কবে কেনা সেটা আমরা খতিয়ে দেখছি। এই গাড়ি কেনার অর্থ কীভাবে পেয়েছেন সেটাও আমরা খতিয়ে দেখব। পরীমণির বাসায় মদের সাপ্লায়ার ছিলেন রাজ, এছাড়া কথিত মডেলদের দিয়ে বিভিন্ন পার্টি এবং ইনডোর প্রোগ্রামের আড়ালে বিশিষ্টজন-ব্যবসায়ীদের সঙ্গে বø্যাকমেইল ও প্রতারণার অভিযোগ রয়েছে। এব্যাপারে তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। আমরা গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পেয়েছি। সেগুলো যাচাই-বাছাই করা হচ্ছে। তদন্তের স্বার্থে তা আপাতত প্রকাশ করা হচ্ছে না।
রাজ জিজ্ঞাসাবাদে জানিয়েছে, এ জাতীয় অবৈধ আয় থেকে অর্থ নামে বেনামে বিভিন্ন ব্যবসায় আমদানি, ড্রেজার বালু ভরাট, ঠিকাদারি ও শোবিজ জগতে বিনিয়োগ করতেন। এসব ব্যবসায় বেশ কয়েকজন অবৈধ অর্থের যোগানদাতাদের সম্পর্কে তথ্য দিয়েছেন। গ্রেফতার প্রত্যেকের ব্যবসায়িক কাঠামোতে অস্বচ্ছতা রয়েছে।
৭ জনের ১০ মামলার তদন্তভার চায় র‌্যাব : র‌্যাবের লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন গতকাল সোমবার বলেন, হেলেনা জাহাঙ্গীর, চিত্রনায়িকা পরীমণি, মডেল পিয়াসা, নজরুল ইসলাম রাজসহ সাত আসামিকে স¤প্রতি গ্রেফতার করেছেন, সেসব মামলার বাদী র‌্যাব। ওই মামলাগুলোর তদন্তভার র‌্যাবকে দেয়ার অনুমতি চেয়ে পুলিশ সদর দফতরে গত রোববার একটি চিঠি দেয়া হয়েছে। আগেও র‌্যাব অভিযান চালিয়ে যেসব আসামিকে গ্রেফতার করেছিল, গুরুত্ব বিবেচনায় কোনো কোনো মামলার তদন্তভার দেয়ার অনুমতি চেয়ে র‌্যাবের পক্ষ থেকে পুলিশ সদর দফতরে চিঠি দেয়া হয়েছিল।
গত ২৯ জুলাই গুলশানের বাসায় অভিযান চালিয়ে হেলেনা জাহাঙ্গীরকে গ্রেফতার করে র‌্যাব। তার বাসায় বিদেশি মদ পাওয়া যায় বলে র‌্যাব জানিয়েছিল। এ ঘটনায় র‌্যাবের পক্ষ থেকে হেলেনা জাহাঙ্গীরের বিরুদ্ধে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনসহ বিভিন্ন আইনে পৃথক পাঁচটি মামলা করা হয়। এর দুদিন পর ১ আগস্ট ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি) বারিধারা ও মোহাম্মদপুরে অভিযান চালিয়ে মডেল ফারিয়া মাহাবুব পিয়াসা ও মরিয়ম আক্তার মৌকে গ্রেফতার করে। তাদের বিরুদ্ধে মামলায়ও বাসা থেকে ইয়াবা ও মদ উদ্ধারের কথা বলা হয়েছে। পরে ৪ আগস্ট র‌্যাব বনানীর একটি বাসায় অভিযান চালিয়ে চিত্রনায়িকা পরীমণি, প্রযোজক নজরুল ইসলাম রাজকে গ্রেফতার করে। র‌্যাবের পক্ষ থেকে পরীমণি ও নজরুলের বিরুদ্ধে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনে বনানী থানায় দুটি মামলা করা হয়। এরপর রাজধানীর বসুন্ধরা এলাকা থেকে মাসুদুল ইসলাম জিসান ও শরফুল হাসান মিশুকে অস্ত্র, মাদক, অশ্লীল ভিডিওসহ গ্রেফতার করে র‌্যাব। এ ঘটনায় র‌্যাবের পক্ষ থেকে মাসুদুল, শরফুল হাসান ও পিয়াসার বিরুদ্ধে ভাটারা থানায় পৃথক চারটি মামলা করা হয়।
সূত্র জানায়, থানা পুলিশ থেকে প্রথমে মামলাগুলোর তদন্তভার পেয়েছিল গোয়েন্দা পুলিশ। পরে পুলিশ সদর দফতর এসব মামলার তদন্ত করার জন্য পুলিশের অপরাধ ও তদন্ত বিভাগকে (সিআইডি) দায়িত্ব দেয়। এখন মামলাগুলো তদন্তের দায়িত্ব চাইল র‌্যাব।
পরীমণি-হেলেনাসহ ১০ আসামির অবৈধ আয় খুঁজছে সিআইডি : চিত্রনায়িকা পরীমণি, আওয়ামী লীগ থেকে বহিষ্কৃত হেলেনা জাহাঙ্গীর, মডেল পিয়াসা-মৌ ও প্রযোজক নজরুল ইসলাম রাজসহ ১০ আসামির অবৈধ কোনো আয় আছে কি না, তা খতিয়ে দেখছে সিআইডি। এসব আসামির মামলার তদন্ত প্রক্রিয়ার সঙ্গে জড়িত সিআইডির একাধিক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলে এই তথ্য জানা গেছে।
সিআইডির ডিআইজি শেখ ওমর ফারুক বলেন, পরীমণি, নজরুল ইসলাম, হেলেনা জাহাঙ্গীরদের নিবিড়ভাবে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। তাদের কাছ থেকে পাওয়া নানা তথ্যাদি যাচাই-বাছাই করা হচ্ছে। তাদের যদি অবৈধ সম্পদের খোঁজ পাওয়া যায়, তাহলে প্রয়োজনীয় আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়া হবে।
মাদক মামলায় গ্রেফতার চিত্রনায়িকা পরীমণি ও তাঁর সহযোগী আশরাফুল ইসলাম, পরীমণির কস্টিউম ডিজাইনার জুনায়েদ করিম জিমি, প্রযোজক নজরুল ইসলাম এবং তার সহযোগী সবুজ আলীসহ সাত আসামিকে রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করছে সিআইডি। পরীমণি, নজরুল ইসলামের জিজ্ঞাসাবাদ শেষ হয়েছে সোমবার। কাল মঙ্গলবার তাদের আদালতে হাজির করবে সিআইডি।
সিআইডি সূত্র বলছে, পরীমণি ও নজরুল ইসলামকে আবার রিমান্ডে নেয়ার আবেদন করা হতে পারে। এ ছাড়া কথিত মডেল ফারিয়া মাহাবুব পিয়াসা, মরিয়ম আক্তার মৌ, আওয়ামী লীগের বহিষ্কৃত নেত্রী হেলেনা জাহাঙ্গীর, মাসুদুল ইসলাম জিসান, শরফুল হাসান মিশুর বিরুদ্ধে করা মামলাও তদন্ত করছে সিআইডি। হেলেনা ও শরফুলকে এখনো নিজেদের হেফাজতে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করেনি সংস্থাটি। তবে অন্যদের রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করছে সিআইডি।

SHARE THIS ARTICLE