ভিটামিন ডি সম্পর্কে যা জানা অত্যন্ত জরুরী

ডাঃ জিন্নুরাইন জায়গীরদার – আইরিশ বাংলাপোষ্ট ডেস্কঃআমাদের শরীরে যতগুলো ভিটামিন অত্যন্ত প্রয়োজনীয়, ”ভিটামিন ডি” তার মধ্যে অন্যতম। কিন্তু কোথায় পাওয়া যায় এই ভিটামিন? এই ভিটামিনের কি কাজ? ভিটামিন ডি শরীরে কত মাত্রায় থাকে? কম থাকলে কি কোন সমস্যা? বেশী থাকলে কি কোন সমস্যা? এই প্রশ্নগুলোর উত্তর জানা আমাদের জন্য গুরুত্ত্বপূর্ন।

� ভিটামিন ডি কোথায় পাওয়া যায় এই প্রশ্নের উত্তর হচ্ছে, সূর্য্যরশ্মীতে (আল্ট্রাভায়োলেট রশ্মি) ! তাই, এই ভিটামিনের মূল উৎস হচ্ছে সূর্য্যরশ্নি। সূর্য্যরশ্মি এবং শরীরের ত্বকের সংশ্লেষন হলো ভিটামিন ডি এর প্রধান প্রাকৃতিক উৎস। সামুদ্রিক কিছু চর্বিযুক্ত মাছ, লাল মাংস, লিভার, ডিমের কুসুমে স্বল্প পরিমাণ ভিটামিন ডি পাওয়া যায়। ত্বকের সংশ্লেষণ এবং খাদ্য থেকে প্রাপ্ত ভিটামিন ডি প্রাথমিকভাবে শরীরে নিষ্ক্রিয় থাকে। এই ভিটামিন, লিভারে এনজাইমের সাথে রাসায়নিক ক্রিয়ার পর ২৫-হাইড্রোক্সি ভিটামিন ডি তে রূপান্তরিত হয়, তারপরে কিডনিতে ১,২৫-ডাই হাইড্রোক্সি ভিটামিন ডিতে পরিণত হয়, আর ১,২৫-ডাইহাইড্রোক্সি ভিটামিন ডি ই হচ্ছে সক্রিয় ভিটামিন। এই ভিটামিনের মূল কাজ হচ্ছে, আমাদের শরীরে ক্যালসিয়াম এবং ফসফরাস এর পরিমান বাড়িয়ে তোলা, দাঁত ও হাড় গঠনেও এটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। বয়স্কদের হাড় এবং পেশীর স্বাস্থ্য বজায় রাখতে ভিটামিন ডি অত্যন্ত প্রয়োজনীয়। এই ভিটামিন ডি বয়স্কদের ক্ষেত্রে পড়ে গিয়ে হাড়ের ফ্র্যাকচার প্রতিরোধে এবং চিকিৎসার ক্ষেত্রে মুখ্য ভূমিকা পালন করে, এছাড়া অন্ত্র থেকে ক্যালসিয়াম শোষণে এই ভিটামিন ডি সহায়তা করে। ভিটামিন ডি শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাকে প্রভাবিত করে।

��ভিটামিন ডি মাপতে হলে, রক্তে ২৫ হাইড্রোক্সিভিটামিন ডি মাপতে হয়। স্বাভাবিক অবস্থায় এর পরিমাণ রক্তে প্রতি মিলি লিটার ২০-৫০ নেনোগ্রাম। সুতরাং রক্তে ভিটামিন ডি এর পরিমাণ ২০ নেনোগ্রামের কম কিংবা ৫০ নেনোগ্রামের বেশী হলে এটা অস্বাভাবিক বলে মনে করা হয়। প্রচণ্ড ভিটামিন ডি এর ঘাটতির কারণে শিশুদের রিকেট, অর্থাৎ হাড়ের পুষ্টি কমে গিয়ে হাড় নরম হয়ে গিয়ে বেঁকে যাওয়া। বড়দেরও হাড় নরম হয়ে ওস্টিওম্যালাসিয়া নামক রোগ হতে পারে। এছাড়াও স্মৃতিশক্তি কমে যাওয়া, হৃদরোগ, হাঁপানি ইত্যাদি বেশ কিছু রোগের সাথে ভিটামিন ডি স্বল্পতার যোগ পাওয়া গিয়েছে। যারা অস্বাভাবিকভাবে কম সূর্যের সংস্পর্শে থাকেন কিংবা খাবারে ভিটামিন ডি এর অভাব কিংবা হজমের মারাত্নক সমস্যা আছে তাদের বেলায় ভিটামিন ডি স্বল্পতা দেখা দিতে পারে। এছাড়া প্রায়ই অসুস্থ থাকা, ক্লান্তি বোধ করা, বিষণ্ণতা, অতিরিক্ত চুল পড়া, শরীরে কোন ঘা হলে তা সেরে উঠতে দেরী হওয়া এসবই ভিটামিন ডি এর স্বল্পতার সাথে জড়িত। তবে বেশ কিছু জরীপে দেখা গিয়েছে, রোগের প্রকাশ না থাকলেও ৩০-৫০ শতাংশ মানুষের রক্তে ভিটামিন ডি স্বল্পতা থাকে। ভিটামিন ডি এর এই ঘাটতি মানুষের হাড়ে ওস্টিওপোরোসিসের বিকাশ এবং প্রাপ্তবয়স্কদের মধ্যে ফ্র্যাকচার এবং পতনের ঝুঁকি বাড়ায় অবদান রাখতে পারে।বেশ কিছু গবেষণায় প্রকাশিত হয়েছে যে, মানুষের শরীরে ভিটামিন ডি এর ঘাটতি, শ্বাসযন্ত্রে ভাইরাস সংক্রমণের ঝুঁকি বাড়ায় এবং কোভিড-১৯ এর কারণে মৃত্যুর ঝুঁকিও বাড়ায়। ভিটামিন ডি এর সাথে শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতার এই সম্বন্ধ অজানা নয়, খুব স্বাভাবিক, কেননা ভিটামিন ডি শরীরের প্রতিরোধ ক্ষমতাকে প্রভাবিত করে। শ্বাসনালীর মনোসাইট / ম্যাক্রোফেজ এবং এপিথেলিয়াল কোষগুলির দেয়ালে ভিটামিন ডি রিসেপ্টর থাকে। আর এই রিসেপ্টারের কারণেই শ্বাসযন্ত্রের সংক্রমণের বিরুদ্ধে সুরক্ষার জন্য ভিটামিন ডি গুরুত্বপূর্ণ হতে পারে। এছাড়াও, ভিটামিন ডি এর একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ হচ্ছে, অতিরিক্ত সাইটোকাইন নিঃসরণকে দমন করা, কোভিড-১৯ এর ক্ষেত্রে, এই “সাইটোকাইন ঝড়” অর্থ সাইটোকাইনের অতিরিক্ত নিঃসরণ এই রোগের উপসর্গ, অসুস্থতা আর মৃত্যুর প্রধান কারণ।সাম্প্রতিক একটি গবেষণায় দেখা গিয়েছে যে, যাদের রক্তে প্রতি মিলিলিটারে ভিটামিন-ডি ৩০-৪০ নেনোগ্রাম তাদের তুলনায় যাদের ২০ নেনোগ্রামের কম তাদের ৫৪ শতাংশ বেশী কোভিডে আক্রান্ত হয়েছেন। রক্তে ভিটামিন ডি এর পরিমাণ যত বাড়তে থাকে ততই এই ঝুঁকি কমতে থাকে যতক্ষণ না রক্তে ভিটামিন ৫৫ নেনোগ্রামের বেশী হয়। এই যে ঝুঁকি, সেটা কিন্তু আগে থেকে অজানা ছিলনা, কেননা শ্বাসযন্ত্রে ভাইরাল সংক্রমণ বিশেষ করে ইনফ্লুয়েঞ্জার সম্ভাবনার সাথে ভিটামিন ডি এর সম্পৃক্ততা আগে থেকেই প্রতিষ্ঠিত। আমরা আগের পরীক্ষা থেকে আরও জানি যে, বাড়তি ভিটামিন ডি, তীব্র শ্বাসযন্ত্রের সংক্রমণ হ্রাস করে, বিশেষ করে যাদের রক্তে ভিটামিন ডি এর ঘাটতি রয়েছে।

জেনে নিন শীতকালে কোন খাবার থেকে ভিটামিন ডি পাবেন - Chuadanga News |  চুয়াডাঙ্গা নিউজ | ২৪ ঘন্টাই সংবাদ

পূর্ববর্তী গবেষণায় দেখা গেছে যে প্রতি মিলিলিটার রক্তে ভিটামিন ডি এর পরিমাণ ৪ নেনোগ্রাম বাড়লে, সংক্রমণের ঝুঁকি ৭ শতাংশ কমে আসে অর্থাৎ প্রতি নেনোগ্রাম বৃদ্ধিতে ঝুঁকি কমে ১.৭৫%। সাম্প্রতিক আরেকটি পরীক্ষায় দেখা গেছে প্রতিদিন ২৫ মাইক্রোগ্রাম (১০০০ ইউনিট) ভিটামিন ডি এক বছর খাওয়া হলে শ্বাসকষ্টের সংক্রমণের ঝুঁকি কমে, উপসর্গ কম হয় এবং এন্টিবায়োটিকের ব্যাবহার কমে আসে। সাম্প্রতিক আরকটি মেটা-এনালাইসিস, বিশ্বের ১৫ টি দেশে পরিচালিত ২৫ টি ট্রায়েলে প্রায় ১১,০০০ জনকে ভিটামিন ডি দেয়া হলে তাদের ঠাণ্ডা লাগা, ফ্লু কিংবা শ্বাসনালীর ইনফেকশনের সম্ভাবনা অর্ধেকে নেমে আসে। আরেকটি মেটা-এনালাইসিস যেখানে ৮ টি ট্রায়েলে ২১,০০০ হাজারের মত মানুষকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছিলো, সেখানে দেখা গিয়েছে যাদের রক্তে ভিটামিন ডি এর পরিমাণ কম ছিল তাদের সংক্রমণের সম্ভাবনা ৬৪ শতাংশ বেশী ছিল।

� এখন প্রশ্ন হচ্ছে, সূর্য্যরশ্নী (আল্ট্রাভায়োলেট রে) কোথায় পাবেন? বাংলাদেশে সারা বছরই প্রচুর সূর্য্যরশ্নী পাওয়া যায়, যার কারণে বাংলাদেশে যারা প্রতিদিন কিছু সময়, সকাল থেকে দুপুরের মধ্যে ঘরের বাহিরে কাটান তাদের ভিটামিনের স্বল্পতা হওয়ার সম্ভাবনা কম। বাংলাদেশে আমরা যদি, প্রতিদিন সূর্য্যালোকে আধা ঘণ্টা ঘরের বাহিরে ঘুরাফিরা করি তাহলে এই ভিটামিনের ঘাটতি হওয়ার সম্ভাবনা কম। কোভিডের কারণে যারা ঘর থেকে বাহিরে যাচ্ছেন না, তারা অতিরিক্ত ভিটামিন ডি ঔষধ হিসাবে গ্রহণ করুন। ইউরোপের বিভিন্ন দেশ যেমন আয়ারল্যান্ডে সারা বছর খুব স্বল্প সময় সূর্য্যরশ্নি পাওয়া যায়, যার কারণে ভিটামিন ডি স্বল্পতা প্রচুর। খুঁজে খুঁজে সকালের রোদ পাওয়া গেলে ভালো। সাম্প্রতিক এক জরীপে আয়ারল্যান্ডে ভিটামিন ডি স্বল্পতা ১৫-৫০% (বয়সের তারতম্য আছে) মানুষের রক্তে পাওয়া গিয়েছে। এই জরীপে প্রবাসীদের আলাদা করে দেখা হয়নি। তবে, যুক্তরাজ্যে একটি জরীপে দেখা গিয়েছে, যারা এশিয়া বংশভূত তাদের ৮৫% এর মত মানুষ ভিটামিন ডি স্বল্পতায় ভুগে থাকেন।

��তাই আমরা প্রবাসী বাংলাদেশী সবাইকে বিশেষ করে শীতের সময় অতিরিক্ত ভিটামিন ডি গ্রহণ করার সুপারিশ করছি, বিশেষ করে কোভিড মহামারী সময়ে। কেউ যদি রক্তে ভিটামিনের পরিমাণ পরীক্ষা করে নিতে পারেন তাহলে সবচেয়ে উত্তম। আপনার জি পি কে অনুরোধ করলে এই টেস্ট সহজেই করা সম্ভব। পরীক্ষা করা না গেলে, কিছুদিন বিশেষ করে শীতের সময় অতিরিক্ত ভিটামিন গ্রহণ করুন। প্রশ্ন হচ্ছে কতটুকু ভিটামিন ডি খাবেন। এই প্রশ্নের উত্তর হচ্ছে, প্রাপ্ত বয়স্করা প্রতিদিন ১০-২০ মাইক্রোগ্রাম (৪০০-৮০০ ইন্টার্নেশনাল ইউনিট) গ্রহণ করলেই চলবে। এই ভিটামিনের জন্য কোন প্রেসক্রিপশনের প্রয়োজন হয়না। যে কোন ফার্মেসী কিংবা ডিপার্টমেন্টাল স্টোরেই এটা পাওয়া যায়।

��আরেকটি কথা; ভিটামিন ডি কি কোভিড-১৯ থেকে আমাদের সুরক্ষা করে? এই প্রশ্নের উত্তর হচ্ছে, এব্যাপারে আমরা সুনিশ্চিত নই। ভিটামিন ডি কে কোভিড-১৯ এর চিকিৎসা হিসাবে নয় বরং রক্তে স্বাভাবিক মাত্রায় ভিটামিন ডি রাখা গেলে শরীরের প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ে এটা সুনিশ্চিত। তাই, আমরা মনে করি, শুধু কোভিড-১৯ নয়, সকল রোগের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে এই ভিটামিনের কার্য্যকারীতা নিশ্চিত।

��সতর্কতা! সাবধান এই ভিটামিন ডি’র পরিমাণ বেশী হয়ে গেলেও ক্ষতি আছে। কি ক্ষতি? এই ভিটামিন ডি অতিরিক্ত হওয়াকে বলা হয় ভিটামিন-ডি টক্সিসিটি। এটা হলে শরীরে ক্যালসিয়াম বেড়ে গিয়ে বমি বমি ভাব, বমি, মাথাব্যাথা, দুর্বলতা, ভুলে যাওয়া, কথা শ্লথ হয়ে যাওয়া, ঘন ঘন প্রস্রাব ইত্যাদি উপসর্গ দেখা দিতে পারে। তাই বলছি কি? ভিটামিন ডি পরিমিত মাত্রায় গ্রহণ করুন। রক্ত পরীক্ষা করিয়ে নিতে পারলে ভালো। না পারলে প্রতিদিন ১০ -২০ মাইক্রোগ্রাম খেলে অতিরিক্ত হওয়ার সম্ভাওনা নাই বললেই চলে, বিশেষ করে আইরিশ বাংলাদেশীদের বেলায়।

SHARE THIS ARTICLE