যেভাবে ইসলাম মানুষকে মূল্যায়ন করে

আইরিশ বাংলাপোষ্ট অনলাইন ডেস্কঃ বহুল প্রচলিত একটি প্রবাদ আছে, ‘এই পৃথিবীতে মানুষের মূল্য আছে ততক্ষণ; মানুষের শরীরে রূহ আছে যতক্ষণ।’ তবে ইসলাম মানুষকে মূল্যায়ন করে ভিন্নভাবে। বংশ-গোত্র, সাদা-কালো এবং ধনী-গরিবের গৌরব আর গরিমার দ্বারা মানুষকে মূল্যায়ন করা হয় না বরং মানুষকে তার কর্ম, বিশ্বাস ও চরিত্রের মাধ্যমে মূল্যায়ন করা হয়।

বংশ-গোত্র, সাদা-কালো এবং ধনী-গরিব হচ্ছে মানব জাতির সৃষ্টিগত গুণাবলি। সৃষ্টিগত গুণাবলি কোনো মানুষের হাতের কামাই নয়; বরং তা শুধু মহান সৃষ্টিকর্তা আল্লাহর হাতে। সৃষ্টিগত গুণাবলির মাধ্যমে পরিচয় নির্ধারণ করা হলেও এগুলোর মাধ্যমে মানুষের শ্রেষ্ঠত্ব মাপা বা মূল্যায়ন করা বোকামি ছাড়া আর কিছুই নয়।

অতএব যেসব গুণ অর্জনের ক্ষমতা মানুষের নেই, সেসব গুণে মানুষের শ্রেষ্ঠত্বও প্রমাণিত হতে পারে না। তাই ইসলাম মানুষকে তার শেষ্ঠ কর্ম ও সুউচ্চ চরিত্রের মাধ্যমে মূল্যায়ন করার নির্দেশ দেয়। মহান আল্লাহ তাআলা বলেন-
‘হে মানবমণ্ডলী!, নিশ্চয়ই আমি তোমাদের একজন নারী ও একজন পুরুষ থেকে সৃষ্টি করেছি এবং বিভিন্ন জাতি ও গোত্রে বিভক্ত করেছি, যাতে তোমরা একে অন্যকে চিনতে পারো। নিশ্চয়ই আল্লাহর কাছে সে-ই সর্বাধিক সম্মানিত, যে সর্বাধিক খোদাভীরু। ’ (সুরা হুজুরাত, আয়াত : ১৩)

কর্মের মাধ্যমেই মানুষের ব্যক্তিত্ব তৈরি হয়। হাদিসে পাকে নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওযা সাল্লামও ইরশাদ করেন-
হজরত আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেছেন, তিনি নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে জানতে চান- হে আল্লাহর রাসুল!, মানুষের মধ্যে সবচেয়ে সম্মানিত ব্যক্তি কে? তিনি বলেন, তাদের মধ্যে যে সবচেয়ে বেশি মুত্তাকি।’ (বুখারি ৩৩৫৩)

হজরত ইবনে ওমর রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেছেন, মক্কা বিজয়ের দিন রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উপস্থিত সাহাবিদের উদ্দেশে ভাষণ দেন এবং বলেন, হে জনমণ্ডলী! তোমাদের থেকে আল্লাহ তাআলা জাহেলি যুগের দম্ভ-অহংকার এবং পূর্বপুরুষদের নিয়ে গৌরব ও আভিজাত্যবোধ বাতিল করেছেন। এখন মানুষ দুই অংশে বিভক্ত-
১. একদল মানুষ নেককার-পরহেজগার। তারা আল্লাহ তাআলার কাছে প্রিয় ও সম্মানিত এবং
২. অন্য দল পাপিষ্ঠ, দুর্ভাগা। তারা আল্লাহ তাআলার কাছে নিকৃষ্ট, নিচু ও ঘৃণিত।
সব মানুষ আদম আলাইহিস সালামের সন্তান। আর আল্লাহ তাআলা আদমকে মাটি দিয়ে সৃষ্টি করেছেন…। (তিরমিজি ৩২৭০)

অন্য বর্ণনায় এসেছে, ‘জেনে রেখো! জাহেলি যুগের গৌরব ও আভিজাত্যবোধের দাবিদার সব কিছু এবং রক্ত ও সম্পত্তি সম্পর্কিত যাবতীয় অন্যায়-অভিযোগ আজ আমার দুই পদতলে পিষ্ট। (আবু দাউদ ৪৫৪৭)

হাদিসে পাকে এসেছে, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন, ‘যার কর্ম তাকে পেছনে ফেলে রেখেছে তার বংশমর্যাদা তাকে অগ্রসর করতে পারে না। ’ (মুসলিম ২৬৯৯)

নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আরও ঘোষণা করেন, ‘কৃষ্ণাঙ্গের ওপর শেতাঙ্গের কোনো শ্রেষ্ঠত্ব নেই। কোনো অনারবের ওপর কোনো আরবের এবং কোনো আরবের ওপর কোনো অনারবের শ্রেষ্ঠত্ব নেই। একজন শ্বেতাঙ্গ একজন কৃষ্ণাঙ্গের তুলনায় এবং একজন কৃষ্ণাঙ্গ একজন শ্বেতাঙ্গের তুলনায় ঊচ্চতর নয়। পার্থক্য নির্ণিত হয় শুধু মানুষের চরিত্র ও কর্মের মাধ্যমে। ’ (মুসনাদে আহমাদ ২৩৪৮৯)

হজরত উকবা ইবনে আমের রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেছেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন, ‘নিশ্চয়ই তোমাদের বংশপরিচয় কাউকে গালি বা লজ্জা দেওয়ার বিষয় নয়। কেননা তোমরা সবাই আদমের সন্তান। সবাই একই মাপের পেয়ালার মতো সমপরিমাণ। একে অন্যের ওপর তোমাদের কোনো প্রাধান্য নেই; (তবে হ্যাঁ) দ্বীন পালন ও নেক আমলে অগ্রসরতা ছাড়া। মানুষের ত্রুটি ও লজ্জার বিষয় হলো দুর্ব্যবহার, অশ্লীলতা, কৃপণতা, কাপুরষতা ইত্যাদি। ’ (মুসনাদে আহমাদ ১৭৩১৩)

একবার সাহাবি হজরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ রাদিয়াল্লাহু আনহু হেঁটে যাচ্ছিলেন। এমন সময় দুজন লোক বংশমর্যাদা নিয়ে অহংকার করছিল। তখন তিনি বলেন, আল্লাহর শপথ! আমার আকাঙ্ক্ষা এটিই যে আল্লাহ তাআলা নিজ রহমতে আমাকে জাহান্নাম থেকে মুক্তি দেবেন, আর এ অবস্থায় যদি আমি কোনো গাধার পায়খানার পাশে দাঁড়িয়ে থাকি এবং আমার কোনো বংশগৌরব না-ও থাকে, তবু এতে আমার কোনো আফসোস নেই। (জামে ইবনে ওয়াহাব ৪৩)

অন্য বর্ণনায় তিনি বলেন, আমার আকাঙ্ক্ষা এটিই যে আল্লাহ তাআলা আমার একটি গুনাহ ক্ষমা করে দেবেন, আর আমার কোনো বংশগৌরব যদি না-ও থাকে। (জামে ইবনে ওয়াহাব হাদিস ২৮)

বংশ গৌরব নয় বরং মানুষের মূল্যায়ন হোক তার কর্ম ও চরিত্রে। যেখানে থাকবে কোনো আভিজাত্য। যেভাবে বলেছেন হজরত ওমর রাদিয়াল্লাহু আনহু। তিনি একবার বলেন, ‘আমার চাওয়া এমন যে আমার বাবা (দূর হাবশা দেশ থেকে আগত গোলাম সাহাবি) বেলালের বাবার মতো হোক, আমার মা বেলালের মায়ের মতো হোক এবং আমি বেলালের মতো হবো, আর এভাবেই আমার জীবন শেষ হবে। (জামে ইবনে ওয়াহাব, হাদিস : ১৮)

আল্লাহ তাআলা মুসলিম উম্মাহকে বংশগৌরবে লিপ্ত না হয়ে নিজ নিজ কর্মের মাধ্যমে অগ্রসর হওয়ার তাওফিক দান করুন। আমিন!

SHARE THIS ARTICLE