সালিশে গিয়ে কিশোরীকে বিয়ে, বরখাস্ত হলেন সেই চেয়ারম্যান

আইরিশ বাংলাপোষ্ট অনলাইন ডেস্ক:  পটুয়াখালীর বাউফল উপজেলায় সালিশ-বৈঠকে অসহায় এক পরিবারকে প্রভাবিত করে অপ্রাপ্তবয়স্ক কিশোরীকে বিয়ে করায় উপজেলার ৬ নম্বর কনকদিয়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মো. শাহিন হাওলাদারকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে। সোমবার (২৮ জুন) রাতে স্থানীয় সরকার বিভাগের এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানানো হয়।

এতে বলা হয়, পটুয়াখালীর বাউফল উপজেলার ৬ নম্বর কনকদিয়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মো. শাহিন হাওলাদার সালিশ করতে গিয়ে ক্ষমতার অপব্যবহার করে অপ্রাপ্ত বয়স্ক (১৪ বছর ২ মাস ১৪ দিন) কিশোরীকে বিয়ে করেন। এ ঘটনায় তিনি স্থানীয় সরকার (ইউনিয়ন পরিষদ) আইন ২০০৯ এর ৩৪ (৪) (ঘ) ধারার অপরাধ সংঘটিত করায় তাকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে।

এছাড়া কেন তাকে চূড়ান্তভাবে অপসারণ করা হবে না তা পত্র প্রাপ্তির ১০ কার্যদিবসের মধ্যে তার জবাব সংশ্লিষ্ট জেলা প্রশাসকের মাধ্যমে স্থানীয় সরকার বিভাগে প্রেরণের নির্দেশ দেয়া হয়েছে বলেও সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়েছে।

এদিকে অপ্রাপ্তবয়স্ক কিশোরীকে বিয়ে করায় পটুয়াখালী জেলা প্রশাসন থেকে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের সচিবের কাছে একটি প্রতিবেদন পাঠানো হয়েছে।

পটুয়াখালীর নবাগত জেলা প্রশাসক (ডিসি) মোহাম্মদ কামাল হোসেন বিষয়টির সত্যতা নিশ্চিত করেছেন।

সালিশ করতে গিয়ে পছন্দ হওয়ায় অন্যের কিশোরী স্ত্রীকে বিয়ের ঘটনা ব্যাপক আলোচিত হয়েছে। ভাইরাল হয়েছে যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে।
ইউপি নির্বাচনে গত ২১ জুন কনকদিয়া ইউনিয়নের দ্বিতীয়বার নির্বাচিত চেয়ারম্যান শাহিন হাওলাদারের (৬০) এমন কাণ্ডে অবাক হয়েছেন এলাকাবাসী। এ চেয়ারম্যান আবার ইউনিয়ন আওয়ামী লীগেরও সভাপতি।

শুক্রবার (২৫ জুন) ওই কিশোরীর সঙ্গে বিয়ের পিঁড়িতে বসেন তিনি। এলাকায় বেশ চাঞ্চল্য সৃষ্টি করা ঘটনাটি স্থানীয় প্রশাসনও গুরুত্ব দিয়ে দেখছে।

এদিকে সালিশে এমন বিচার দেখে কিশোরীর সঙ্গে পালানো তরুণ (২৫) আত্মহত্যার চেষ্টা করেন। শুক্রবার রাত থেকে বাউফল উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি আছেন।

স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, কনকদিয়া ইউনিয়নের নারায়ণপাশা গ্রামের এক তরুণের সঙ্গে একই ইউনিয়নের ওই কিশোরীর সঙ্গে প্রেমের সম্পর্ক ছিলো দীর্ঘদিন ধরে। কিশোরী স্থানীয় একটি স্কুলের অষ্টম শ্রেণির ছাত্রী। কিন্তু প্রেমের সম্পর্ক মেনে নিতে পারেননি মেয়ের বাবা। প্রেমিক-প্রেমিকা গত তিন দিন আগে বাসা থেকে পালিয়ে গেলে কিশোরীর বাবা তাদেরকে পাশের বাড়ির এক আত্মীয়ের বাসা থেকে ধরে নিয়ে আসেন। সেই সঙ্গে বিষয়টি সমাধানের জন্য চেয়ারম্যান শাহিন হাওলাদারকে জানান।

শাহিন হাওলাদার শুক্রবার ইউনিয়ন পরিষদে সালিশ ডাকেন। বৈঠকে দুই পরিবারের সদস্যরা উপস্থিত ছিলেন। সেখানে ওই তরুণ কেন কিশোরীকে নিয়ে পালিয়ে গিয়েছিলো এর কোনও সদুত্তর দিতে পারেননি। তবে বৈঠকে কিশোরীকে দেখে পছন্দ হয়ে যাওয়ায় অভিভাবকের কাছে বিয়ের প্রস্তাব দেন চেয়ারম্যান শাহিন হাওলাদার। মেয়ের বাবা বিয়েতে সম্মতি প্রকাশ করলে ওইদিন বাদ জুমা চেয়ারম্যানের আয়লা বাজারের বাসায় কাজি ডেকে পাঁচ লাখ টাকা কাবিনে বিয়ে করেন।

তবে সালিশের কথা অস্বীকার করে চেয়ারম্যান মো. শাহিন হাওলাদার দাবি করেন, দীর্ঘদিন ধরে ওই কিশোরীর সঙ্গে তার সম্পর্ক ছিলো। বিষয়টি পারিবারিকভাবে জানা ছিলো সবার। আমার বিয়ের প্রয়োজন থাকায় সবাইকে অবগত করেছি। একপর্যায়ে গত ২১ জুন নির্বাচনে জয়ী হয়ে ওইদিন রাতেই তার সঙ্গে বিয়ের কাবিন করেছি। পরে পারিবারিকভাবে গত শুক্রবার জুমার নামাজের পর বিয়ের আনুষ্ঠানিকতা সেরে তাকে আমার ঘরে নিয়ে আসি। বিয়েতে উভয়পক্ষের লোকজন উপস্থিত ছিলো।

তিনি বলেন, কনকদিয়া ইউনিয়নের দায়িত্বপ্রাপ্ত কাজি স্থানীয় মুছা মাওলানার ছেলে বিবাহ সম্পন্ন করেছেন। কিন্তু তার নাম বলতে পারেননি চেয়ারম্যান।

এ বিষয়ে চেয়ারম্যান বলেন, এই মুহূর্তে তার নাম আমার মনে নেই। আমার নিকটাত্মীয় হাফেজ আবু সাদেক বিয়ের সময় দোয়া ও মিলাদ পড়িয়েছেন।

জানতে চাইলে হাফেজ আবু সাদেক জানান, কাবিন ও বিয়ে শুক্রবারই হয়েছে। কিন্তু চেয়ারম্যান যে বলেছেন, ‘২১ জুন কাবিন হয়েছে’ এমন প্রশ্নের জবাবে হাফেজ সাদেক বলেন, সেটা তিনিই ভালো জানেন। আমি শুক্রবার তাদের পাঁচ লাখ টাকা কাবিন করিয়েছি। আমার কাছে কাগজপত্রসহ প্রমাণ আছে। সেখানে মেয়ের বাবা, চাচা, স্থানীয় গণ্যমান্য ব্যক্তিরা উপস্থিত ছিলেন।

মেয়ে অষ্টম শ্রেণিতে পড়ে, এটি তো বাল্যবিয়ের মধ্যে পড়ে, বিষয়টি যাচাই করেছেন কি না- এমন প্রশ্নের জবাবে সাদেক হোসেন জানান, ইউনিয়ন পরিষদ থেকে জন্মসনদ দাখিল করেছে। সেখানে তার বয়স ১৮ দেখানো হয়েছে। তা দেখেই কাবিন করিয়েছি। তাছাড়া সেখানে মেয়ে ও মেয়ের বাবা-চাচাসহ স্থানীয় গণ্যমান্য ব্যক্তিরা উপস্থিত থাকায় আমরা বিস্তারিত যাচাই করিনি।

একই প্রশ্নের জবাবে চেয়ারম্যান শাহিন হাওলাদার জানান, সে তিন বছর আগে নবম শ্রেণির ছাত্রী ছিলো। বর্তমানে সে লেখাপড়া করে না। জন্মসনদ অনুযায়ী তার জন্ম তারিখ ২০০৩ সালের ১১ এপ্রিল।

তবে জন্ম তারিখের বিষয়ে আপত্তি জানিয়ে ওই কিশোরীর বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক পরিমল চন্দ্র জানান, সে বর্তমানে অষ্টম শ্রেণির নিয়মিত শিক্ষার্থী। শুক্রবার চেয়ারম্যান শাহিন হাওলাদারের সঙ্গে ওই শিক্ষার্থীর বিয়ের ঘটনা কিছুক্ষণ আগে লোকমুখে শুনেছেন এবং তিনি অবাক হয়েছেন এতে।

কিশোরীর বাবা বলেন, সালিশে আমি বলেছি, আজকে যদি এর একটা ব্যবস্থা না হয় তাহলে আমি আর মেয়ে নেবো না (ওই ছেলের সঙ্গে দিয়ে দেবে)। এ কথার জবাবে চেয়ারম্যান বলেন, ‘তাহলে আপনার মেয়েকে আমার কাছে দিয়ে দেন, মেয়েকে আমি নিয়ে যাই’। রাগের মাথায় আমি বলেছি, আপনি নিয়ে যান। এতে যে এ ঘটনা ঘটবে আমি তা বুঝতে পারিনি।

বাউফল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আল মামুন জানান, লোকমুখে ঘটনা শুনেছি। তবে মেয়ের পক্ষ থেকে কেউ কোনও অভিযোগ করেনি। যদি বাল্যবিয়ের অভিযোগ পাওয়া যায়, তবে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

ঘটনার সত্যতা স্বীকার করে বাউফল উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. জাকির হোসেন জানান, মেয়ের বয়স নির্ধারণ নিয়ে ইতোমধ্যে যাচাই-বাছাই শুরু করেছি। তার জন্মসনদ এবং স্কুলের সার্টিফিকেট সবকিছু আমরা সংগ্রহ করেছি।

ঘটনার আগে থেকেই চেয়ারম্যান শাহিন হাওলাদারের প্রথম স্ত্রী পটুয়াখালী অবস্থান করছেন। তবে এ বিষয়ে তার সঙ্গে যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি। চেয়ারম্যানের এক ছেলে ও এক মেয়ে রয়েছে। ছেলে বিবাহিত।

এদিকে, প্রেমঘটিত সালিশ বৈঠকে মেয়েকে দেখে পছন্দ হওয়ার পর তাৎক্ষণিক বিয়ে করা পটুয়াখালীর বাউফল উপজেলার কনকদিয়া ইউনিয়ন পরিষদের সেই চেয়ারম্যান শাহিন হাওলাদারসহ ছয় জনের নাম উল্লেখ করে মামলা হয়েছে। আজ সোমবার বেলা ১১টায় মো. আল ইমরান নামে এক ব্যক্তি পটুয়াখালী জেলা সিনিয়র জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট মো. জামাল হোসেনের দ্বিতীয় আদালতে বাদি হয়ে মামলাটি করেন।

এদিকে, কিশোরীকে চেয়ারম্যানের নিজেই বিয়ে করার ঘটনা তদন্ত করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন হাইকোর্ট। পটুয়াখালীর ডিসি, জেলা নিবন্ধক ও পিবিআইকে তদন্ত করে আলাদা তিনটি প্রতিবেদন আগামী ৩০ দিনের মধ্যে সুপ্রিম কোর্টের রেজিস্ট্রার জেনারেলের কাছে দাখিল করতে বলা হয়েছে।

SHARE THIS ARTICLE