ডাঃ জিন্নুরাইন জায়গীরদারঃ কোভিড-১৯ এর বিরুদ্ধে মডার্নার ভ্যাকসিনের সাফল্যে আবারো আনন্দিত হলো বিশ্বের মানুষ। শেষ ধাপের পরীক্ষার অন্তর্বর্তীকালীন বিশ্লেষণ থেকে প্রাপ্ত ফলাফলে দেখা যাচ্ছে এক সপ্তাহ আগে ফাইজার/বায়োনটেক-এর ভ্যাক্সিনের মতোই কিংবা তার থেকে কিছুটা ভালো সাফল্য এসেছে মডার্নার ভ্যাকসিন ভাণ্ডারে। মডার্নার পরীক্ষায় ৯৪.৫% আর ফাইজারের পরীক্ষায় ৯০% এরও বেশি-অসুস্থতা থেকে রক্ষা পেয়েছেন। আজই এই ঘোষণাটি দিয়েছেন মডার্নার চিফ এক্সিকিউটিভ অফিসার।
এটি মানবজাতির জন্য দুর্দান্ত খবর। বোঝা যাচ্ছে ভ্যাকসিন তৈরির নূতন পদ্ধতিটি সত্যি কাজ করছে। দুটি ভ্যাকসিনই একটি নতুন প্রযুক্তি ব্যবহার করে তৈরি করা হয়েছে, যা আগে কখনও ব্যাবহার করা হয়নি। এই নূতন পদ্ধতিতে মেসেঞ্জার আরএনএ (এমআরএনএ) কে ব্যাবহার করা হয়েছে। এই মেসেঞ্জার আর এন এ করোনা ভাইরাসের উপরের স্পাইক প্রোটেনের বিরুদ্ধে শরীরে এন্টিবডি তৈরি করবে। এর পর যদি সেই মানুষ ভাইরাস দ্বারা আক্রান্ত হন তাহলে শরীরের এন্টিবডি, ভাইরাসের স্পাইক প্রটেনকে অকার্য্যকর করে দেবে। অনেকেই মনে করছেন, এটি সস্তা ও নিরাপদ, তাই বিভিন্ন রোগের জন্য এই পদ্ধতি ব্যাবহার করে ভবিষ্যতে আরও ভ্যাকসিন তৈরির সম্ভাবনা রয়েছে। আপাততঃ মনে হচ্ছে কোভিড-১৯ সংক্রমণ থেকে বেঁচে থাকতে এই পদ্ধতির ভ্যাকসিন আমাদের সহায়তা করবে।
মডার্না ভ্যাকসিনের একটি বৈশিষ্ট্য হলো এটিকে -২০ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেডে রাখতে হবে, তার অর্থ হচ্ছে সাধারণ ফ্রিজারে এটি সংরক্ষণ করা যাবে এবং সাধারণ ফ্রিজারে এটি এক মাস পর্য্যন্ত সংরক্ষণ করা যাবে। কিন্তু ফাইজার/বায়োনটেক ভ্যাকসিনের কার্য্যকারিতা ধরে রাখার জন্য অতি-কোল্ড চেইন-ফ্রিজারের সাহায্যে -৭০ থেকে এবং -৮০ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড তাপমাত্রায় রাখতে হবে, যার জন্য লাগবে বিশেষ ধরনের বিশেষায়িত অতি কোল্ড ফ্রিজার এবং ফ্রিজারে এটি রাখা যাবে মাত্র ৫দিন। বেশীরভাগ দেশেই এই অতি কোল্ড তাপমাত্রায় ভ্যাকসিন পরিবহন ও সংরক্ষণ অত্যন্ত দুরূহ এবং ব্যায়সাপেক্ষ ব্যাপার হবে।সেদিক দিয়ে মডার্নার ভ্যাকসিন নিয়ে এসেছে অতিরিক্ত সুসংবাদ।
তবে এই ভ্যাকসিনটি খুবই ব্যয়বহুল হবে, মডার্না তাদের প্রতি ডোজের মূল্য ৩৭ ডলার (৩১ ইউরো) দাবী করছিলেন যেখানে জনসন এন্ড জনসন ১০ ডলার এবং ফাইজার ২০ ডলার দাম চেয়েছিলেন। স্বাভাবিকভাবেই বেশী পরিমাণে কেনা হলে মূল্য কিছুটা কমে আসবে, তবে আমরা জানি মডার্না একটি বাণিজ্যিক সংস্থা এবং তারা লাভের ব্যাপারে আগ্রহী সেটা আগেই প্রকাশিত হয়েছিলো।
মডার্নার প্রাথমিক লক্ষ্য হবে মার্কিন বাজার। তারা এই ভ্যাকসিন তৈরির জন্য মার্কিন সরকারের কাছ থেকে প্রায় ২৪৮ কোটি ডলার পেয়েছে। এই ভ্যাকসিনটি ডোনাল্ড ট্রাম্পের অপারেশন ওয়ার্প স্পিড প্রোগ্রামের উজ্জ্বল আশা ছিল, আর যদি কয়েকদিন আগে এই সুসংবাদ পাওয়া যেত তাহলে, মার্কিন নির্বাচনের আবহাওয়া কি হত বলা মুশকিল। এ বছরের শেষ নাগাদ, এই সংস্থাটি ২ কোটি ডোজ যুক্তরাষ্ট্রে সরবরাহের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারন করেছে।
দামের কারণে এবং মার্কিন সরকারের সাথে সংযোগের কারণে, বিশ্বের অন্যান্য দেশের এই ভ্যাকসিনের জন্য অপেক্ষা করতে হবে। স্বল্প আয়ের দেশগুলিকে অন্য কোথাও ভ্যাকসিনের খোজ করতে হবে। জাতিসংঘের কোভাক্স প্রোগ্রাম, দরিদ্র দেশগুলিতে করোনভাইরাস ভ্যাকসিন কেনায় ভর্তুকি দেবে, তবে মোডারনা যে দাম চায়, তা এই ভর্তুকীর জন্য খুব ব্যয়বহুল হতে পারে।
মডার্নার একটি ইতিবাচক দিক হচ্ছে, মহামারির কথা ভেবে মডার্না জানিয়েছে, কোভিড-১৯ মহামারী চলাকালে তার ভ্যাকসিনে পেটেন্ট অধিকার প্রয়োগ করবে না অর্থাৎ এটি সম্ভব যে অন্য যে কোন দেশ এই ভ্যাকসিন স্বল্পমূল্যে তৈরি করে বাজারজাত করতে পারবেন, এব্যাপারে ভারত এবং চীন ভালো ভূমিকা রাখতে পারে। বাংলাদেশের গ্লোব বায়োটেক কোম্পানি একটি ভ্যাকসিন নিয়ে কাজ করছে। এই কোম্পানি কিংবা অন্য যে কোন কোম্পানি এই কাজটি দ্রুত সম্পন্ন করার উদ্যোগ নিতে পারে।
যাই হোকনা কেন, আশার কথা যে ইতিমধ্যে দুটি ভ্যাকসিনের সুসংবাদ আমরা পেয়ে গেছি। আমরা আরও আশা করি, দেশে দেশে লকডাউন, ঘরে বসে থেকে অবসাদ এবং অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের হাত থেকে রক্ষা করার জন্য ভ্যাকসিনগুলো গুরুত্ত্বপূর্ন ভূমিকা রাখবে। আম্যাডের প্রত্যাশা অচিরেই আরও ভ্যাকসিনের সুসংবাদ আমরা পাবো, যা সহজলভ্য হবে এবং তা দ্রুততম সময়ে মানুষের নিকট পৌঁছে দিয়ে আমরা মহামারীকে পরাজিত করতে পারব। দেশে দেশে এবার শুরু হবে কর্মযজ্ঞ, আয়োজন, অনুষ্ঠান। হাসপাতালে অসময়ে মৃত্যু কমে যাবে, নূতন আশায় ভর করে আবার জেগে উঠবে সভ্যতা।