ডাঃ জিন্নুরাইন জায়গীরদারঃ আজ বড়দিন। বিশ্বব্যাপী ২৪০ কোটি খৃষ্টধর্মের অনুসারী মানুষের ধর্মীয়, সাংস্কৃতিক আর অর্থনৈতিক বৃহত্তম উৎসবের দিন আজ। আমরা এই দিনে সকলকে জানাই আন্তরিক শুভেচ্ছা।
যিশু খ্রিস্টের জন্মদিন
আজ থেকে দুই হাজারের বেশী বছর আগে জেরুজালেমের বেথলেহেমে জন্ম নিয়েছিলেন জিশুখৃষ্ট (ঈসা আঃ সাঃ)। যদিও সুনিশ্চিত জন্মতারিখ কারো জানা নেই তবুও এই দিনটিকে নির্ধারন করা হয়েছে উৎসব পালনের উদ্দেশ্যে। ৩৩ বছরের স্বল্পস্থায়ী জীবনে যিশু মানুষকে শুনিয়েছেন শান্তির বাণী, ভালোবাসার কথা। হিংসা-দ্বেষ, পাপ-পংকিলতা থেকে মানুষকে মুক্ত করা ছিল তার মূল কথা। তার জন্ম ছিল অলৌকিক এবং ক্ষমতা ছিল ঐশ্বরিক। স্রষ্টার আদেশে পৃথিবীর একমাত্র মানব যিনি শুধুই মাতৃজঠরে বেড়ে উঠেছিলেন, কোন পিতার অস্তিত্ব ব্যাতীত। জন্মেই তার কণ্ঠে কথা এসেছিলো আর যৌবনে ঐশী ক্ষমতাবলে তিনি অসুস্থকে সুস্থতা আর মৃতকে জীবিত করে দিতে পারতেন।
তার বাণী ছিল শাশ্বত, শান্তির। অত্যচার, অনাচার, অবিচারের বিরুদ্ধে তিনি ছিলেন অকুতোভয়। স্রষ্টার বাণী প্রচারের সময় অমানুষিক নির্যাতনের শিকার হয়েছিলেন তিনি। কিন্তু কোনো নির্যাতন-নিপীড়নই তাকে সত্যের পথ থেকে বিচ্যুত করতে পারেনি। মানুষকে জয় করার হাতিয়ার ছিল তার সংযম ও সহিষ্ণুতা। পরিশেষে রোমান শাসকের আদেশে তাকে ক্রুশে বিদ্ধ করে হত্যা করা হয়, যদিও বিশ্বাসীরা তাকে মৃত মনে করেন না, স্রষ্টার আদেশে তাকে উঠিয়ে নেয়া হয়েছে স্বর্গে, পুনরায় মানবজাতিকে মুক্তির উদ্দেশ্যে তার আগমন ঘটবে। এসমস্ত ঘটনার ঐতিহাসিক ভিত্তি থেকে জনশ্রুতি শক্তিশালী। ধর্মীয় বিশ্বাস তার থেকেও শক্তিশালী। আজকের বৈশ্বিক কোভিড মহামারীর এই সময়ে যখন জীবন অকালে ঝরে যাচ্ছে লক্ষ লক্ষ, অসুস্থ হচ্ছে কোটি কোটি, বিপর্য্যস্ত সভ্যতা, এই সময়ে যীশু খৃষ্টের মত অলৌকিক ক্ষমতাধারী একজন ঐশ্বরিক মানুষের বড়ই প্রয়োজন।
আয়ারল্যান্ডে বড়দিন উদযাপন
বড়দিন পালনের ইতিহাস খুব দীর্ঘ নয়। আর এই দিন সম্পর্কিত আনুষ্ঠানিকতা আর আচার বিবর্তিত হয়েছে যুগে যুগে। ধর্মীয় আচারের সাথে যুক্ত হয়েছে আখ্যান, সংস্কৃতি আর কাহিনী। বিশ্ব সম্প্রদায়ের সাথে আয়ারল্যান্ডেও প্রতিবছর এই সময়ে মহা আড়ম্বরে পালিত হয় বড়দিন। প্রতি বছর ৮ই ডিসেম্বর থেকে বড়দিনের (ক্রিসমাস) অনুষ্ঠানাদি যেমন সাজসজ্জা, ক্রিসমাস বৃক্ষ লাগানো ইত্যাদি দিয়ে শুরু হয়ে ৬ই জানুয়ারি “লিটল ক্রিসমাসের” মাধ্যমে শেষ হয়।
প্রজাতন্ত্রী আয়ারল্যান্ডের ৯০ শতাংশেরও জনগণ খ্রিষ্টান ধর্মাবলম্বী, এখানে এখনো রাষ্ট্রযন্ত্রের অনেক কিছুই চার্চের নিয়ন্ত্রনাধীন, বিশেষ করে শিক্ষা এবং স্বাস্থ্য, তাই বড়দিন এই দেশের ধর্মীয়, সাংস্কৃতিক এবং অর্থনৈতিক অঙ্গনে অত্যন্ত গুরুত্ত্বপূর্ন ভূমিকা পালন করে। বড়দিন এবং তার আগের মধ্যরাতের প্রার্থনা, ক্যাথলিক খ্রিষ্টানদের নিকট এখনো জনপ্রিয়। এই সময়ে মৃতদের জন্য বিশেষ প্রার্থনা, আত্নীয় স্বজনের কবরকে হলি এবং আইভি পুষ্প স্তবকে সজ্জিত এবং কবর দর্শন করা হয়ে থাকে। এই সময়ে কেউ মারা গেলে তারা সরাসরি স্বর্গে চলে যাবেন বলেও অনেকের বিশ্বাস।
সাজ সজ্জা কিভাবে করা হয়?
দীর্ঘ সময় থেকেই এই সময়ে আইরিশ জনগোষ্ঠী তাদের ঘরদোর পরিষ্কার, পরিচ্ছন্ন, ঝাড়পোছ, রং লাগানো ইত্যাদি করে নিজেদের বাসস্থান সাজ সজ্জার মাধ্যমে বড়দিনের প্রস্তুতি সম্পন্ন করে। চিরসবুজ উদ্ভিদ যেমন মিসল-টো এবং হোলি উদ্ভিদের ব্যাবহার সার্বজনীন কেননা হোলি উদ্ভিদ খ্রিষ্টের প্রতিনিধিত্ব করে বলে ধারনা করা হয়। ক্রিসমাস বৃক্ষের ব্যাবহার শুরু হয় রানী ভিক্টোরিয়ার শাসনকালে বিশেষ করে ১৮৪০ সালের পর থেকে ঘরে বাইরে এই সবুজ বৃক্ষকে ধারণ করে শোভা বর্ধন আজ সার্বজনীন রীতিতে পরিণত হয়েছে। প্রতিটি ঘরে, বাজারে এবং পথে পথে এই সবুজ গাছ খ্রিস্টমাস বৃক্ষ শোভা পায়। মোমাবাতির ব্যাবহার থেকে আজ রাজপথে, দোকান পাটে আর ঘরে বাহিরে রঙ্গিন বাতির ঝলমলে আলোকসজ্জা এবং উপহার বিনিময় অত্যন্ত জনপ্রিয় এবং বড়দিনের উৎসবের প্রাণ। নারীরা এই সময়ে সাজ সজ্জা করেন প্রচণ্ড, উপচে পড়া ভিড় থাকে বাহারি কেশ সজ্জা আর প্রসাধনীর দোকানে।
সান্টাক্লজ (সান্টা) কি?
সান্তা ক্লজ কিংবা সান্টা পশ্চিমা খ্রিস্টান সংস্কৃতি থেকে উদ্ভূত এক কিংবদন্তী চরিত্র, বলা হয় যে সান্টা সারা বিশ্বের শিশুদের আচরণ অনুসারে তালিকা তৈরি করে ভালো শিশুদের বড়দিনের আগের রাতে বিভিন্ন ধরনের উপহার সামগ্রী আর দুষ্ট ধরনের শিশুদের জন্য উপহার দেয় কয়লা। মনে করা হয় উত্তর মেরুতে তার ওয়ার্কশপে খেলনা তৈরি করা ক্রিসমাস এলভসের (পরীর) সাহায্যে এবং উড়ন্ত বল্গা-হরিণের স্লেজগাড়ির সাহায্যে বিভিন্ন জায়গায় টেনে নিয়ে যাওয়া হয়।
আধুনিক সময়ে সান্তা ক্লজ চতুর্থ শতাব্দীর আধুনিক তুর্কি শহর “ডেমরে” যা গ্রীক-রোমান সময়ে “মাইরা” নামে খ্যাত ছিল সেই শহরের উপহারদাতা গ্রীক বিশপ সেন্ট নিকোলাস, ব্রিটিশ ফাদার ক্রিসমাস আর ডাচ সিন্তারক্লাসের এই সময়ে উপহার প্রদানের রীতির সাথে সম্পৃক্ত।সেইন্ট নিকোলাস, সিন্টারক্লাস থেকে সান্তা ক্লজের নামকরণ বলেই অনেকের ধারনা।
সান্টাকে সাধারণত একটি স্থূল, হাসিখুশি, সাদা দাড়িওয়ালা মানুষ হিসাবে দেখানো হয়, প্রায়শই চোখে চশমা লাগিয়ে, সাদা পশমের কলার এবং কাফের সাথে একটি লাল রঙের ট্রাউজার, কোট, লাল টুপি পোশাক পরা, কালো চামড়ার বেল্ট এবং বুট পরা অবস্থায় একটি ব্যাগে করে শিশুদের উপহার সামগ্রী নিয়ে চলাচল করতে দেখা যায়। কাল্পনিক এই সান্টা চরিত্রটি আকর্ষনীয়, দয়ালু আর সার্বজনীন উপহার প্রদানকারী হওয়ায় শিশুদের নিকট অত্যন্ত জনপ্রিয়।
বড়দিনের মোমবাতি
মোমবাতি দিয়ে আলোকসজ্জার প্রচলন এখনো রয়ে গেছে। বিশেষ করে ঘরের জানালায় মোমবাতি জ্বালিয়ে অভ্যর্থনা জানানো হয় অতিথিদের।
বড়দিনের সাঁতার
বড়দিনে সকালে অনেকেই চলে যান হিমশীতল ঠাণ্ডায় সাগর জলে সাঁতার কাটতে, এটাই প্রচলিত রীতি। এই সাঁতারের মাধ্যমে অর্থ উত্তোলন করে জনহিতকর কাজে ব্যায় করাই মূল উদ্দেশ্য।
বড়দিনের সান্ধ্য ভোজ
বড়দিনের সান্ধ্য ভোজ হচ্ছে সবচেয়ে আকর্ষনীয় আনুষ্ঠানিকতা। এই দিনে সকলেই ফিরে যান নিজের পিতা মাতার সাহ্নিদ্ধ্যে। মায়ের হাতের প্রথাগত রান্না সবাই মিলে খাওয়াটা হচ্ছে তাদের জন্য গুরুত্ত্বপূর্ন। এই কাজটা করা না গেলে বড়দিনের উৎসব যেন অপূরন থেকেই যায়। ইতিহাসে এবার ২০২০ সাল সম্ভবতঃ স্প্যানিশ ফ্লু এর পর দ্বিতীয় সময় যখন অনেকেই পিতামাতার সাহ্নিধ্য বঞ্চিত হবেন, মহামারির কারণে।
সাধারণতঃ এই ভোজে আয়োজন থাকে বিশাল। বড় দিনে সাগরের মাছ রান্নার আয়োজন আজকাল কমে এসেছে। খাবারের মেনুতে গরুর মাংস, শুকর, হাঁসের গ্রিল কিংবা রোস্ট অন্তর্ভুক্ত থাকে। বিভিন্ন ধরনের সবজী থাকে খাবারের ম্যানুতে। আধুনিক সময়ে যুক্ত হয়েছে গ্রিলড এন্ড স্টাফড টার্কি। মিষ্টান্নতে থাকে বড়দিনের পুডিং, বড়দিনের কেক, শেরী ট্রিফল, ইউলি লগ আর মিন্স পাই এবং সেই সাথে পুডিং এর উপর ছড়ানো ব্রান্ডি। সাথে থাকে হাজারো ধরনের বিস্কুট আর চকোলেট। মুটামুটিভাবে রাজকীয় আয়োজন লক্ষ লক্ষ ক্যালোরি একদিনেই সাবাড়, সেই সাথে এক দিনেই অর্থ ব্যয়ের বন্যা। এছাড়া সারা মাসব্যাপী চলতে থাকে বিভিন্ন রেস্টুরেন্টে সান্ধভোজের বন্যা। বন্ধু, বান্ধব, আত্নীয় স্বজন সবাইকেই আপ্যায়ন করা হয় অবারিত। সেই সাথে আয়োজন থাকে গান, নাচ আর পানীয়ের।
সাধারণতঃ এই ভোজে আয়োজন থাকে বিশাল। বড় দিনে সাগরের মাছ রান্নার আয়োজন আজকাল কমে এসেছে। খাবারের মেনুতে গরুর মাংস, শুকর, হাঁসের গ্রিল কিংবা রোস্ট অন্তর্ভুক্ত থাকে। বিভিন্ন ধরনের সবজী থাকে খাবারের ম্যানুতে। আধুনিক সময়ে যুক্ত হয়েছে গ্রিলড এন্ড স্টাফড টার্কি। মিষ্টান্নতে থাকে বড়দিনের পুডিং, বড়দিনের কেক, শেরী ট্রিফল, ইউলি লগ আর মিন্স পাই এবং সেই সাথে পুডিং এর উপর ছড়ানো ব্রান্ডি। সাথে থাকে হাজারো ধরনের বিস্কুট আর চকোলেট। মুটামুটিভাবে রাজকীয় আয়োজন লক্ষ লক্ষ ক্যালোরি একদিনেই সাবাড়, সেই সাথে এক দিনেই অর্থ ব্যয়ের বন্যা। এছাড়া সারা মাসব্যাপী চলতে থাকে বিভিন্ন রেস্টুরেন্টে সান্ধভোজের বন্যা। বন্ধু, বান্ধব, আত্নীয় স্বজন সবাইকেই আপ্যায়ন করা হয় অবারিত। সেই সাথে আয়োজন থাকে গান, নাচ আর পানীয়ের।
উপহার বিনিময়
পারিবারিক উপহার বিনিময়, এমনকি প্রতিবেশী, বন্ধুবান্ধব সকলের জন্যই উপহারের ব্যাবস্থা থাকে। উপহার কিনতে গিয়েই অনেকের সারা বছরের সঞ্চয় ব্যয় করে ফেলা হয়। অনেকে এবার ক্রেডিট কার্ড থেকে ব্যয় করেন দ্বিধাহীন চিত্তে আর তারপর সারা বছরের উপার্জন থেকে প্রতিমাসে ফিরিয়ে দেন ঋণের বিশাল অর্থ।
বাংলাদেশে বড়দিন উদযাপন
প্রতি বছর এই দিনে বিশ্বের খ্রিষ্টান বিশ্বাসীদের সঙ্গে বাংলাদেশের খ্রিস্টান সম্প্রদায়ও ধর্মীয় অনুভূতির পরম মমতায় আনন্দঘন পরিবেশে উৎসবটি পালন করে থাকেন। দিনটি উপলক্ষে যিশুখ্রিস্টের জন্মের কাহিনী পাঠ ও ধ্যান করা হয়। সেই কাহিনী অবলম্বনে গির্জাঘরে, এমনকি প্রত্যেক বাড়িতে গোশালা নির্মাণ করে ফুলপাতা দিয়ে সাজানো হয়।
গান-বাজনা, নাম-সংকীর্তন, ভোজন, আনন্দ-উল্লাস ইত্যাদি চলে। এসব বাহ্যিক উৎসব-আয়োজনের ঊর্ধ্বে খ্রিস্ট বিশ্বাসীরা তাদের হৃদয়-মন ও অন্তরাত্মাকে পবিত্র ও পরিশুদ্ধ করতে প্রয়াসী হন। তাদের এই আনন্দ-উৎসব যাতে নিছক আচারিক বা অনুষ্ঠানসর্বস্ব না হয় সেজন্য বড়দিনের পূর্ববর্তী চার সপ্তাহব্যাপী আগমনকাল হিসেবে পালনের ব্যবস্থা করেন। এ সময়ে খ্রিস্টভক্তরা ধ্যান-অনুধ্যান, মন পরীক্ষা, ব্যক্তিগত পাপ স্বীকার, সমবেত পুনর্মিলন বা ক্ষমা-অনুষ্ঠান ইত্যাদির মাধ্যমে মানুষে মানুষে সম্পর্কের উন্নয়ন ও নবায়ন করতে সচেষ্ট হন।
বড়দিনের উৎসবে মুসলমান সম্প্রদায়ও যোগ দিয়ে থাকেন এবং আনন্দ ভাগ করে নেন। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির এ এক অনন্য দৃষ্টান্ত। আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামে উল্লেখযোগ্যসংখ্যক খ্রিস্ট ধর্মাবলম্বী অংশ নিয়েছিলেন, তাদের অনেকেই আত্নাহূতি দিয়েছেন। বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগের সময়ও মুসলমান, খ্রিস্টান, হিন্দু ও অন্য ধর্মাবলম্বীরা ঐক্যবদ্ধ হয়ে পরিস্থিতি মোকাবেলায় অংশ নিয়েছেন।
ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর খ্রিস্ট ধর্মাবলম্বীরাও একাকার হয়ে আছেন এ দেশের মুসলমান সম্প্রদায়ের সঙ্গে। বড়দিন উপলক্ষে আমরা বিশ্বের সকল দেশে, বিশেষ করে বাংলাদেশে এবং আয়ারল্যান্ডের সকল খ্রিস্টান সম্প্রদায়কে জানাই শুভেচ্ছা। বড়দিনের উৎসব সার্বজনীনতা লাভ করুক। এ ধর্মীয় উৎসবে সব ধর্মের মানুষের মধ্যে সংহতি গড়ে তুলতে সহায়ক হবে এবং তা বিশ্বভ্রাতৃত্বের বন্ধন দৃঢ় করবে বলেই আমাদের প্রত্যাশা। আইরিশ বাংলা পোস্ট বড়দিনের উৎসবের সার্বিক সাফল্য কামনা করে সকলকে উষ্ণ শুভেচ্ছা জানাচ্ছে।