
ডাঃ ইসমত কবিরঃ গত ডিসেম্বরে কোভিড১৯ এর সূচনা হয় চীনের উহান প্রদেশে। এ দুর্দান্ত সংক্রামক রোগটির প্রতিরোধে টিকার গবেষণাও শুরু হয় চীনে।রোগটির কারণ হিসেবে করোনা ভাইরাস চিহ্নিত হওয়ার সাথে সাথে চীনের সংশ্লিষ্ট সরকারী ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো টিকা নিয়ে কাজে নেমে পড়ে। এর মধ্যে সব চেয়ে বড় উদ্যোগ নেয় রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান সিনোফার্ম উহান ও সিনোফার্ম বেইজিং।
সিনোফার্ম এর টিকা
সংযুক্ত আরব আমীরাতের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় সিনোফার্মের টিকার নিবন্ধন দিয়েছে ০৯ই ডিসেম্বর, ২০২০। ইতিপূর্বে এর জরুরী ব্যবহার এর অনুমোদন দেওয়া হয়েছিলো। আমীরাতে এ টিকার চূড়ান্ত ট্রায়াল এর অন্তর্বর্তীকালীন ফল বিশ্লেষণ শেষে এ সিদ্ধান্ত ঘোষণা করা হয়। ১২৫টি জাতিগোষ্ঠীর ৩১০০০ স্বেচ্ছাসেবী ‘ফর হিউম্যানিটি’ (4Humanity) নামের এ ট্রায়ালে অংশ নেন। জানানো হয়, এ টিকাটি নিরাপদ ও ৮৬ শতাংশ ক্ষেত্রে রোগ প্রতিরোধে সক্ষম। গুরুতর ও জটিল কোভিড-১৯ প্রতিরোধে এটা শতভাগ কার্যকর। ৯৯ শতাংশ ক্ষেত্রেটিকা গ্রহণকারীদের শরীরে নিষ্ক্রিয়করণ এন্টিবডির উপস্থিতির প্রমাণ মিলেছে। দেশটির আমীর, মন্ত্রী পরিষদ সদস্য ও উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা প্রায় সকলেই এ টিকা নিয়েছেন।প্রচলিত প্রযুক্তির নিষ্ক্রিয় কোভিড-১৯ এর ভাইরাসকে মূল উপাদান বানিয়ে একাধিক টিকার নীরিক্ষা শুরু করে সিনোফার্ম বছরের গোড়ার দিকে।
সফল গবেষণা, প্রথম ও দ্বিতীয় পর্বের ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল শেষে চার মহাদেশ জুড়ে দশটি দেশে এর তৃতীয় পর্যায়ের ট্রায়াল শুরু হয় গত জুন ২০২০ এ। ট্রায়াল এর লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয় ৬০,০০০ স্বেচ্ছাসেবী। দেশগুলোর মধ্যে আছে সংযুক্ত আরব আমীরাত, বাহরাইন, জর্দান, মিশর, আর্জেন্টিনা ও পেরু। আপৎকালীন জরুরী ব্যবহারবিধির আওতায় চীনে এর সরকারী অনুমোদন দেওয়া হয় তৃতীয় পর্বের আনুষ্ঠানিক ফল প্রকাশ ছাড়াই।
গত নভেম্বর, ২০২০ পর্যন্ত এ টিকাটি চীনের দশ লক্ষ লোককে দেওয়া হয়। কারো মাঝেই উল্লেখযোগ্য কোন পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া লক্ষ্য করা যায় নি।করোনা আক্রান্ত দেশে সফরকারী চীনের ছাত্র, কুটনীতিবিদ, সামরিক-বেসামরিক কর্মী সকলকে এ টিকা দেওয়া হয়, ৬ই নভেম্বর পর্যন্ত এ সংখ্যাটি ছিল ৫৬০০০। কারো মাঝেই কোন বিরূপ উপসর্গর দেখাও মেলেনি।একটা উদাহরণ দেওয়া হয়েছে, একটি বহুজাতিক প্রতিষ্ঠান এর কার্যালয়ের ৯৯ জন কর্মীর ৮১ জনকে এ টিকা দেওয়া হয়। এলাকায় কোভিড১৯ এর প্রকোপ দেখা দিলে টিকা নেননি এমন ১৮ জনের মধ্যে ১০ জন কোভিড১৯ এ আক্রান্ত হন। টিকা গ্রহণকারী ৮১ জনের সকলেই করোনা মুক্ত থাকতে সক্ষম হন।
আগামী এক বছরে একশোটি দেশে একশো কোটি ডোজ টীকার বিপণন, উৎপাদন বা সরবরাহের উদ্যোগ নিয়েছে চীনা প্রতিষ্ঠান সিনোফার্ম। প্রয়োজনে একশো কোটি ডলার পর্যন্ত রাষ্ট্রিয় ঋণের সুযোগ দিতে প্রস্তুত চীন। দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশও রয়েছে। উন্নয়নশীল দেশগুলিতে স্বল্পমূল্যে টিকা সরবরাহ ও বিতরণ এর আন্তর্জাতিক সংস্থা হচ্ছে ‘কোভ্যাক্স’। দেরীতে হলেও এর সদস্য হয়েছে চীন। রাশিয়া ও যুক্তরাষ্ট্র এ সংস্থা থেকে এখনও দূরে রয়েছে।
সিনোভ্যাক এর করোনা ভ্যাক
বেসরকারী প্রতিষ্ঠান সিনোভ্যাক ‘করোনাভ্যাক’ টিকা নিয়ে সামনের সারিতেই অবস্থান করছিলো। এটাও প্রচলিত প্রযুক্তির নিষ্ক্রিয় কোভিড-১৯ ভাইরাস দিয়ে তৈরি একটি টিকা। বাংলাদেশে এর চূড়ান্ত পর্যায়ের ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল হওয়ার কথা থাকলেও শেষ পর্যন্ত তা হয়নি। ব্রাজিলের চলমান ট্রায়ালে একজন টিকাগ্রহণকারী স্বেচ্ছাসেবীর মৃত্যু হলে ট্রায়ালে ছেদ পড়ে। এদিকে মূল প্রতিষ্ঠানের শীর্ষ কর্মকর্তা টিকার অনুমোদন লাভের জন্য চীনের ওষুধ নিয়ন্ত্রণ সংস্থার নির্বাহীদের ঘুষ দিয়েছেন আদালতে এমন অভিযোগ উঠে।

এসব বাধা সত্ত্বেও ইন্দোনেশিয়ায় ‘করোনাভ্যাক’ এর বার লক্ষ ডোজের প্রথম চালান ইতোমধ্যে সরবরাহ করা হয়েছে। আগামী মাসে আরও আঠার লক্ষ ডোজ পৌঁছে যাবে। দেশটির চূড়ান্ত ট্রায়াল এর ইতিবাচক ফলের প্রেক্ষিতে এ অগ্রগতি হয়।’করোনাভ্যাক’ তুরস্ক, ব্রাজিল ও চিলিতে সরবরাহের চুক্তি হয়েছে।
ক্যানসিনো বায়োলজিক্স এর টিকা
চীনের সাড়া জাগানো তৃতীয় টিকা ক্যানসিনো বায়োলজিক্স এর টিকা একটি বাহক-ভাইরাস নির্ভর অগ্রসর প্রযুক্তির টিকা। ‘হিউম্যান এডেনোভাইরাস ০৫’ এখানে বাহক হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে। প্রযুক্তিগত দিক থেকে এটার সাথে যুক্তরাজ্যের অক্সফোর্ড, যুক্তরাষ্ট্রের ‘জনসন এন্ড জনসন’, রাশিয়ার গামালিয়া ইন্সটিটিউট এর বাহক-নির্ভর টীকাগুলোর মিল আছে। চীনের সেনাবাহিনী এ টিকার গবেষণা, উৎপাদন ও ট্রায়াল এর অংশীদার। এ টিকাটির প্রথম ও দ্বিতীয় পর্বের ট্রায়াল নিয়ে বৈজ্ঞানিক নিবন্ধ ল্যানসেট এ প্রকাশিত হয় ১৮ই জুলাই, ২০২০।চীনে জরুরী ব্যবহার এর জন্য সরকারী অনুমোদন দেওয়া হলে সামরিক বাহিনীর সদস্যদের এ টিকা প্রদান শুরু হয়।চীন ছাড়াও পাকিস্তান ও রাশিয়ার চারটি স্থানে এর চূড়ান্ত পর্বের ট্রায়াল চলছে।এ তিনটি উল্লেখযোগ্য টিকা ছাড়াও চীনে আরও অন্তত চারটি নিরীক্ষাধীন টিকা নিয়ে গবেষণা বা ট্রায়াল চলছে।