১০ লক্ষ করোনায় মৃত্যু একটি পরিসংখ্যান মাত্র

জিন্নুরাইন জায়গীরদার – আইরিশ বাংলাপোষ্ট ডেস্কঃ ৩০ শে সেপ্টেম্বর ২০২০,
কোভিড-১৯ মহামারীতে বিশ্বে মৃতের সংখ্যা গত ২৮শে সেপ্টেম্বর ১০ লক্ষ পেরিয়ে গেলো। অফিশিয়ালি স্বীকৃত ১০ লক্ষ মানুষের মৃত্যুর মধ্য দিয়ে আধুনিক সভ্যতায় রাষ্ট্র ব্যাবস্থাপনা এবং চিকিৎসা বিজ্ঞানের ব্যর্থতার একটি চিত্র বিশ্ব সমাজের নিকট প্রতিভাত হয়েছে, মুখ থুবড়ে পড়েছে বিশ্ব অর্থনীতি আর সেই সাথে এই মহামারী বদলে দিয়েছে সমাজ চিত্র। এখন আর কেউ কারো সাথে হাত কিংবা বুক মিলাতে পারেনা, ৬ ফুট দূরে দূরে থাকতে হয়, অবিরত হাত ধৌত করতে হয়, আর মুখে লাগিয়ে রাখতে হয় মুখোশ। 

Coronavirus: 5 deaths and 248 new COVID-19 cases - Galway Daily

১০ লক্ষ কেবলমাত্র একটি পরিসংখ্যান যা দিয়ে কোনভাবেই ক্ষয়ক্ষতি কিংবা বেদনা পরিমাপ করা যাবে না। যারা হারিয়েছে তাদের ভাই কিংবা বোন, বন্ধু কিংবা স্বজন, পিতা কিংবা মাতা, পুত্র কিংবা কন্যা, স্বামী কিংবা স্ত্রী তারাই জানে হারানোর বেদনা কত গভীর। এই বেদনার সাথে যুক্ত হয়েছে আরও গভীর ক্ষত, অনেক ক্ষেত্রেই আত্নীয়, বন্ধু কিংবা স্বজনের মৃতদেহ  সৎকার করতে পারেনি এমনকি দেখতেও যেতে পারেনি, কি ভয়াবহ অবস্থা।

A Single Death is a Tragedy, a Million Deaths is a Statistic” | Bob's  NewHeart

আজ থেকে ৩৩৩ দিন আগে যখন চীনের হুবেই প্রদেশের উহান শহরে এই রোগের উৎপত্তি হয় তখন কেউ ভাবতেই পারেনি এই রোগের পরিণতি এত ভয়াবহ হয়ে উঠতে পারে। ইতিমধ্যে বিশ্বে আনুষ্ঠানিকভাবে আক্রান্তের সংখ্যা ৩কোটি ৩৭ লক্ষ ছাড়িয়ে গিয়েছে এর মধ্যে ২ কোটি ৫০ লক্ষ মানুষ সেরেও উঠেছে। 

আমরা যদি মৃত্যুর একটি টাইমলাইন তৈরি করি তাহলে দেখতে পাবো,

১।১০ই জানুয়ারি ২০২০- মৃত্যু ১
অজানা ভাইরাসে উহানে ১০ই জানুয়ারি ৬১ বছরের এক পুরুষের মৃত্যু দিয়ে শুরু হয়েছিলো বিস্ময়কর, অনাকাঙ্ক্ষিত এক মৃত্যুর মিছিল। চীন থেকে অফিশিয়ালি তা প্রকাশিত হয় ১১ই জানুয়ারি ২০২০ তখন শুধুমাত্র ধারনা করা হয়েছিলো যে, করোনা নামক ভাইরাসের কারণে নিউমোনিয়া হয়ে এই মৃত্যু হয়ে থাকতে পারে। এরপর দ্রুত ছড়িয়ে পড়তে থাকে এই রোগ।

২।২৮শে জানুয়ারি- মৃত্যু ১ শত  
১৮ দিনের মাথায় মৃত্যুর এই সংখ্যা ১ শত অতিক্রম করে, তারিখ ২৮শে জানুয়ারি। ইতিমধ্যে এই ভাইরাস চীনের সীমানা অতিক্রম করে বিশ্বের আরও ১৬টি দেশে ছড়িয়ে পড়েছিলো। উহান সহ হুবেই প্রদেশে ইতিমধ্যে লকডাউন কার্য্যকর করা হয়েছে, হুবেই এর বাহিরে কিছু কিছু স্থানে বিধি নিষেধ আরোপিত হয়েছে। জনসাধারণ্যে মুখোশ পরাটাও চীন বাধ্যতামূলক করেছিলো। ইতিমধ্যে স্বাস্থ্য বিভাগ থেকে প্রকাশ করা হয়েছিলো যে উহানের একটি বন্যপ্রাণীর বাজার থেকে ভাইরাসটি উদ্ভূত হয়েছিল। ৩০শে জানুয়ারি ওয়ার্ল্ড হেলথ অর্গানাইজেশন থেকে বৈশ্বিক জরুরী অবস্থা হিসাবে ব্যাক্ত করা হয়। 

৩।১০ই ফেব্রুয়ারি-মৃত্যু ১ হাজার
১ শত থেকে ১ হাজার অতিক্রম করতে এই রোগটির সময় লাগে মাত্র ২ সপ্তাহ। এই সময়ে বিশ্বের ২৭টি দেশে এই রোগ ছড়িয়ে পড়ে তবে চীনা মূল ভূখণ্ডের বাহিরে ফিলিপিনস এবং হংকংয়ে তখন কেবল দু’জনের মৃত্যু হয়েছিল। এদিকে, ফেব্রুয়ারির শেষের দিকে, ডায়মন্ড প্রিন্সেস জাহাজের কয়েক শত যাত্রী এই রোগে আক্রান্ত হলে জাহাজটিকে জাপানে কোয়ারেন্টাইনে রাখা হয়। এই জাহাজেরই একজন যাত্রী কোভিডে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেন, তিনি ছিলেন প্রথম মৃত্যুবরণকারী যুক্তরাজ্যের নাগরিক। একই সময়ে করোনাভাইরাসকে কোভিড-১৯ নামকরণ করা হয়।

৪।২০শে মার্চ- মৃত্যু ১০ হাজার
দুই মাসের মাথায়, বিশ্বজুড়ে ভাইরাসজনিত মৃত্যুর এই সংখ্যা যখন ১০ হাজার পেরিয়ে যায়, মহামারীর ঢেউ তখন ইউরোপে পৌঁছে গেছে। প্রথমে এই ঢেউ লাগে ইটালিতে, দ্রুত বাড়তে থাকে  এই সংখ্যা, এই সময়ে শুধুমাত্র ইটালিতে ৪ হাজারেরও বেশী মানুষের মৃত্যু হয়েছিল। ইটালিতে মার্চের প্রথম দিকেই লক ডাউন ঘোষিত হয়েছিল। ইতিমধ্যে চীন লক ডাউন থেকে সুফল পেতে শুরু করে, যার ফলশ্রুতিতে মার্চের শেষ সপ্তাহে নূতন কোন কোভিড রোগী শনাক্ত ছাড়া চীন ২য় দিন অতিক্রম করে। বিশ্বজুড়ে আক্রান্তের সংখ্যা দাড়ায় ২ লক্ষ ৫০ হাজার। আয়ারল্যান্ডে লক ডাউন ঘোষণা করা হয় ১২ই মার্চ কিন্তু যুক্তরাজ্য লক ডাউন ঘোষণা করা থেকে বিরত থাকে। যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন হার্ড ইমিউনিটির কথা বলে বিশ্ববাসীকে হতবাক করে দেন। কিন্তু যুক্তরাজ্যে সংক্রমণ দ্রুত ছড়াতে থাকে এবং মৃত্যুর সংখ্যা ৩৩৫ অতিক্রান্ত হলে বরিস জনসন তার নীতি পরিবর্তন করে ২৪শে মার্চ সারা দেশে লক ডাউন ঘোষণা করেন। বাংলাদেশে লক ডাউন ঘোষণা করা হয় ২৬শে মার্চ, কিন্তু এই লক ডাউন শুধু ঘোষণাতেই ছিল, কার্য্যকর হয়েছিলো আংশিক।  

৫।৯ই এপ্রিল- মৃত্যু ১ লক্ষ 
ইতিমধ্যে বিশ্ব পরিস্থিতি সম্পুর্ন নূতন রূপ ধারণ করে। তিন মাস পরের পৃথিবী আমাদের নিকট অপরিচিত মনে হতে থাকে, নূতন অবস্থানে কোভিড মহামারীতে মৃতের সংখ্যা এক লাখ অতিক্রম করে। ১০ই এপ্রিলের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রে কোভিড আক্রান্তের সংখ্যা বিশ্বে সর্বাধিক হয়ে পড়ে। ডোনাল্ড ট্রাম্প বারে বারে তার নীতির পরিবর্তন করেন, এই সময়ে তিনি জানান যে, যুক্তরাষ্ট্রে মৃতের সংখ্যা ১ লক্ষ অতিক্রম করতে পারে। ট্রাম্পের ধারনাকে ভুল প্রমাণিত করে যুক্তরাষ্ট্রে মৃতের সংখ্যা সেপ্টেম্বরের শেষের দিকে ২ লক্ষ ছাড়িয়ে গেছে। ইউরোপে ইস্টারের সময়েও লক ডাউন চলতে থাকে। বরিস জনসন কোভিডে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে চিকিৎসা গ্রহণ শেষে, ১৯শে এপ্রিল ইনটেনসিভ কেয়ার থেকে বেরিয়ে আসেন। এই সময় যুক্তরাজ্যে আক্রান্তের সংখ্যা ৭০ হাজার অতিক্রম করে আর মৃতের সংখ্যা ৯ হাজার অতিক্রম করে। 

৬।২৯শে জুন- মৃত্যু ৫ লক্ষ
কোভিড মহামারী জুন মাসে নূতন মাত্রা পেয়ে মৃত্যুর সংখ্যা ৫ লক্ষ অতিক্রম করে। লক ডাউনের ফলে সংক্রমণের সংখ্যা কমতে থাকলে আয়ারল্যান্ড সহ বিশ্বের বেশ কিছু দেশ লক ডাউন থেকে সরে আসতে শুরু করে। যুক্তরাষ্ট্র, ব্রাজিল, আফ্রিকা ও দক্ষিণ এশিয়ার বিভিন্ন দেশে সংক্রমণ বাড়তে থাকে দ্রুত।  

৭।২৮শে সেপ্টেম্বর- মৃত্যু ১০ লক্ষ
গত সোমবার, বিশ্বে কোভিড-১৯ এ আক্রান্ত হয়ে মৃতের সংখ্যা ১০ লক্ষ অতিক্রম করলো। জন হপকিন্স বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিসংখ্যান অনুসারে যুক্তরাষ্ট্র, ব্রাজিল এবং ভারত এই তিন দেশের মোট মৃত্যু এখন সর্বমোট মৃত্যুর প্রায় অর্ধেক।

পরিসংখ্যান ১০ লক্ষ অতিক্রম করলেও সংক্রমণ আজো থামেনি , আর কখন থামবে তা কেউ জানেনা, ঠিক একইভাবে মৃত্যুও থামেনি, থামার কোন লক্ষণও নেই। মৃত্যুর এই পরিসংখ্যান সঠিক বলে মনে করারও তেমন কোন কারণ নেই। অনেক ক্ষেত্রেই কোভিড শনাক্ত ছাড়াই অনেকে মৃত্যু বরণ করেছেন, অনেক দেশে যথেষ্ট পরীক্ষা করা সম্ভব হয়নি, অনেক দেশ পরিসংখ্যান গোপন করেছে, এছাড়াও আছে টেস্টের ভুল ফলাফল। সব মিলিয়ে এই পরিসংখ্যান দ্বিগুণ কিংবা তিনগুণও হতে পারে। সঠিক পরিসংখ্যান কখনো জানাও যাবেনা। 

মানুষ দীর্ঘদিন বন্দী জীবন কাটিয়ে এখন ধৈর্য্য হারিয়ে ফেলছে। ভারতের মত দেশ সম্পূর্ন বিপর্য্যস্ত হয়ে পড়েছে, এখনও দ্রুত বাড়ছে সংক্রমণের সংখ্যা। বাংলাদেশের পরিস্থিতি লেজে গোবরে, পরীক্ষা অর্ধেকে নামিয়ে আনা হয়েছে, জনগণ পরীক্ষার উপর আস্থা হারিয়ে ফেলেছে, অনেকেই ঘরে চিকিৎসা নিচ্ছেন তবে মৃত্যুর হার তূলনামূলকনভাবে কম। বাংলাদেশে মৃত্যুর হার তূলনামূলকভাবে কম হওয়ার কারণ হিসাবে মোট জনসংখ্যার অধিকাংশের বয়স ষাটের কম, ভিটামিন ডি এর ঘাটতিহীনতা এবং অধিকাংশ কৃষক এবং শ্রমিকের শক্তিশালী রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতার কথা উল্লেখিত হলেও তার পক্ষে এখনো কোন সঠিক স্টাডি প্রকাশিত হয়নি।তবে বাংলাদেশে জনজীবন অনেকটাই স্বাভাবিকের মত বলে  অনেকেই মনে করছেন।

যাই হোক না কেন ১০ লক্ষ মৃত্যু দিয়ে কি কোভিডের ইতি হয়েছে? না, তা হয়নি। কোভিড এখনও অপ্রতিরোধ্য গতিতে এগিয়ে চলেছে। অনেকেই আশা করছেন সহসাই বেরিয়ে আসবে আলাউদ্দিনের আশ্চর্য্য প্রদীপ “কোভিড ভ্যাক্সিন”। এই ভ্যাক্সিন নিয়ে রাজনীতি, ব্যাবসা আর বিজ্ঞান এখন মুখোমুখি। রাজনীতিবিদ আর ব্যাবসায়ীরা কে কার আগে ভ্যকাসিন বাজারে আনবেন সেই প্রতিযোগিতায় মত্ত, বিজ্ঞানীরা নিরলস কাজ করছেন আর সারা বিশ্বের জনগণ আশা নিয়ে তাকিয়ে আছে কখন আবির্ভাব হয়, আলাউদ্দিন তার ম্যাজিক ল্যাম্প নিয়ে। 

3" Aladdin's Magic Lamp Genie Incense Holder Oil Burner For Burning  Incense. | eBay
SHARE THIS ARTICLE